‘না, আমার মনে হয় না।’
‘আমারও মনে হয় না, কিন্তু আমাদের সেটা শিখতে হবে।’
‘আমি জানি।’
‘তুমি জানো, তাই না? অবশ্যই তুমি জানো।’
নানু কাশতে কাশতে একটা ট্রাফিক লাল বাতি উপেক্ষা করে গাড়ি ছুটিয়ে চললো। কনর আন্দাজ করার চেষ্টা করলো রাত কতটা হয়েছে। রাস্তায় তেমন ট্রাফিক নেই এখন।
‘কিন্তু নাতি, তুমি জানো কি, আমাদের মধ্যে একটা মিল আছে।’
‘আছে?’ কনর এখন হাসপাতাল দেখতে পাচ্ছে।
‘হ্যাঁ।’ নানুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে।
‘কী সেটা?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
হাসপাতালের সামনে গাড়িটা থামিয়ে নানু তার দিকে সোজা তাকিয়ে বললো,
‘তোমার মা। আমাদের মাঝে এই একটা জিনিসই মিল আছে।’
কনর কিছু বললো না।
সে জানে, নানু কী বলতে চাইছেন। মা নানুর মেয়ে, নানুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর সে কনরের মা।
এই মিলটা খুব বড়ো একটা মিল।
ইঞ্জিন বন্ধ করে নানু দরজা খুললো, ‘আমাদের জলদি যেতে হবে।’
সত্য
নানু তার আতঙ্কিত চেহারায় একটা প্রশ্ন নিয়ে হাসপাতালের রুমে ঢুকল। নার্স তাকে দেখে সাথে সাথেই বলে দিলো, ‘সবকিছু ঠিক আছে, আপনারা সময়মতো এসেছেন।’
নানু যেন স্বস্তিতে কেঁদে উঠলো।
‘আপনি ওকে নিয়ে আসতে পেরেছেন তাহলে!’ নার্স কনরকে দেখে বললো।
‘হ্যাঁ।’ কেবল এটুকুই বললো নানু।
কনর আর নানু মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরটা অন্ধকার, কেবল মায়ের বিছানার ওপরে আলো পড়ছে। তার চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে যেন তার বুকের ওপর ভারী কিছু বসে আছে। নার্স তাদের রেখে চলে গেল। নানু বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মায়ের একটা হাত তুলে নিলো। হাতে একটা চুমু খেল সে।
‘মা?’ কনর শুনতে পেল। মা তার নিজের মাকে ডাকছে, এত আস্তে ডাকছে যেন শোনাই যায় না।
‘আমি এসে পড়েছি, সোনা!’ নানু মায়ের হাত ধরেই বললো, ‘কনরও এসে গেছে।’
‘এসেছে?’ চোখ না খুলেই বললো মা।
নানু তার দিকে তাকালো। কিছু একটা ইশারা করলো।
‘আমি এসেছি, মা।’ কনর বললো।
মা কিছু বললো না, কেবল হাতটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। যেন হাতটা ধরতে বলছে, কখনও যেন সে হাতটা ছেড়ে না দেয় ।
‘এখানে এই গল্পের সমাপ্তি হবে।’ পেছন থেকে বললো দানবটা।
‘আমি কী করবো?’ কনর ফিসফিসিয়ে বললো
সে অনুভব করলো দানবটা তার কাঁধে হাত রেখেছে।
‘কেবল সত্যিটা বলতে হবে তোমাকে।’
‘আমার ভয় করছে।’
নানু তার মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। মা তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে কখন কনর হাতটা ধরবে।
‘অবশ্যই তুমি ভয় পাবে, কিন্তু তবু তোমাকে করতে হবে।’ দানবটা তাকে ঠেলে এগিয়ে দিলো।
দানবটা কনরের হাত তার মায়ের দিকে এগিয়ে দিতেই ঘড়িটা কনরের চোখে পড়লো। এখন ১১টা বেজে ৪৬ মিনিট।
১২টা ৭ বাজার আরও বিশ মিনিট বাকি ।
দানবকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে–এরপর কী হবে? কিন্তু সাহস পেল না।
কারণ তা সে নিজেই জানে।
‘তুমি যদি এখন সত্যি বলো, তাহলে সামনে আর যাই আসুক না কেন, তুমি তার মোকাবেলা করতে পারবে।’
কনর তার মায়ের হাতের দিকে তাকালো, চোখে পানি চলে এসেছে তার। সে দুঃস্বপ্নে ডুবে যাচ্ছে না, কিন্তু তারপরও তার কষ্ট হচ্ছে।
সে মায়ের হাত ধরলো।
মা খুব কষ্টে চোখ খুলে তাকে দেখলো আর পরক্ষণেই বন্ধ করে ফেললো।
কনর জানে, অন্তিম সময় উপস্থিত। এখনই হবে এটা। সে যাই ভাবুক বা করুক না কেন, এখনই সেটা হতে যাচ্ছে।
আর সে এটাও জানে, এসব এখন সে সহ্য করতে পারবে।
যন্ত্রণা হবে, ভীষণ যন্ত্রণা হবে, কিন্তু সে বাঁচতে পারবে।
এ কারণেই দানবটা এসেছে। কনরের তাকে প্রয়োজন ছিল, আর সেই কোনোভাবে তাকে ডেকেছে। এরপর সেটা জীবন্ত হয়ে এসেছে, কেবল এই মুহূর্তের জন্যে।
‘তুমি থাকবে?’ কনর দানবকে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তুমি ততক্ষণ থাকবে যতক্ষণ–’
‘আমি থাকবো।’ দানব কনারের কাঁধে আবার হাত রাখলো, ‘তোমাকে এখন কেবল সত্যিটা বলতে হবে, আর কিছু না।’
এবার কনর তা-ই করলো।
অবশেষে সে সত্যিটা বললো।
‘আমি চাই না তুমি চলে যাও।’ তার চোখ থেকে বন্যার মতো অশ্রু ঝরছে।
‘আমি জানি, সোনামণি’ মা ভারী কণ্ঠে বললো, ‘আমি জানি।’
কেবল এটুকুই বলার ছিল তার।
এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো সে।
সে জানে সময়টা হয়ে গেছে, হয়তো ১২টা ৭ বেজে গেছে, যে মুহূর্তে মা তার হাত পিছলে চলে যাবে, চিরতরে।
‘কিন্তু এখনও সেই সময় হয়নি।’ দানবটা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘এখনও সময় হয়নি।’
কনর মাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে রাখলো ।
আঁকড়ে ধরেই সে তাকে চলে যেতে দিলো।