‘এটা আমার দোষ, আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি, এটা আমার দোষ। ‘
‘এটা তোমার দোষ না।’ দানবের কণ্ঠটা যেন বাতাসের মতো তার চারপাশে ভাসতে লাগলো।
‘এটা আমারই দোষ । ‘
‘তুমি কেবল এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাচ্ছিলে, তোমার নিজের যন্ত্রণা থেকে। একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে। এটা সামান্য মানবিক একটা ব্যাপার।’
‘আমি এমনটা চাইনি।’
‘তুমি চেয়েছো, আবার চাওনি।’
‘দুটোই একসাথে কীভাবে সত্যি হতে পারে?’
‘কারণ মানুষ খুবই জটিল বস্তু। রানি কীভাবে একইসাথে ভালো এবং খারাপ হয়েছিল? যুবরাজ কীভাবে খুনি এবং উদ্ধারকারী হলো? এপথকেরি কীভাবে রাগী এবং সঠিক দিক-নির্দেশনাকারী হয়েছিল? কীভাবে লোকটা ভালো হৃদয়ের, কিন্তু ভুল চিন্তার লোক ছিল? অদৃশ্য মানুষটা কীভাবে দৃশ্যমান হওয়া সত্ত্বেও আরও একাকি হয়ে গেল?’
‘আমি জানি না’ কনরের ক্লান্ত লাগছে, ‘তোমার গল্পের আগামাথা আমি কখনোই বুঝিনি।’
‘উত্তরটা হচ্ছে–তুমি যতই ভাবো না কেন, তোমার চিন্তাভাবনা নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তুমি তাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছো, আবার একইসাথে তাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছো। তোমার মন শান্তিদায়ক মিথ্যাকে বিশ্বাস করছিল, কিন্তু এটাও জানতো যে একটা যন্ত্রণাদায়ক সত্যি এই মিথ্যেগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। তোমার মন তোমাকে সত্য-মিথ্যা দুটোই বিশ্বাস করার জন্য শাস্তি দিচ্ছে।’
‘কিন্তু এসবের মোকাবেলা কীভাবে করবো? ভেতরের চিন্তার মোকাবেলা কীভাবে করা যায়?’
‘সত্যি বলে, যেভাবে তুমি এইমাত্র বলেছো।’
কনর আরও একবার ভাবলো কীভাবে তার মায়ের হাত ছুটে যাচ্ছিল—’
‘এসব ভাবনা থামাও, কনর ও’ম্যালি।’ দানবটা খুব নরমভাবে বললো, ‘এ কারণেই আমি জীবন্ত হয়েছি, তোমাকে এসব বলতে যেন তুমি সেরে উঠতে পারো, তোমাকে শুনতে হবে।’
‘আমি শুনছি।’
‘কেবল কথা বলে জীবনগাথা বানাতে পারবে না, তোমাকে করে দেখাতে হবে। তুমি কী ভাবছো সেটা জরুরি না, তুমি কী করছো সেটা জরুরি।’
কনর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
‘তাহলে আমি কী করবো?’
‘যেটা তুমি এইমাত্র করেছো, সত্যিটা বলা।’
‘এটুকুই?’
‘তোমার মনে হচ্ছে এটা খুব সহজ? তুমি সেটা বলার চেয়ে মরে যেতে পছন্দ করেছিলে।’
কনর মাটির দিকে তাকালো, ‘আমি ভেবেছিলাম আমার চিন্তাটা খুবই ভুল।’
‘এটা ভুল নয়।’ দানব বললো, ‘এটা কেবল একটা চিন্তা, লাখ লাখ চিন্তার মধ্যে একটা।’
কনরের নিঃশ্বাস এখনও ভারী, তবে আগের মতো দম বন্ধ হয়ে আসছে না। দুঃস্বপ্নটা তাকে কাবু করতে পারছে না।
সত্যি বলতে, তার মনে হলো দুঃস্বপ্নটা আর নেই ।
‘আমি খুব ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।’ সে তার মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো।
‘তাহলে ঘুমিয়ে যাও, এখনও সময় আছে।’
‘সত্যিই আছে?’ কনর ফিসফিস করে বললো, চোখ খুলে রাখতেও তার কষ্ট হচ্ছে।
দানবের হাতটা কনরের জন্য আরামদায়ক একটা জায়গা হয়ে গেল ।
‘আমি মাকে দেখতে যাবো।’
‘যাবে, কথা দিচ্ছি।’
কনর চোখ মেললো, ‘তুমি তখন থাকবে?’
‘হ্যাঁ।’ দানবটা বললো, ‘আমার জীবন্ত হওয়ার শেষ কিছু সময় হবে সেটা।’
কনর গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।
তলিয়ে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করলো সে, ‘তুমি সবসময় ১২টা ৭ মিনিটেই আসো কেন?’
উত্তর দেওয়ার আগেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে মিল
‘ধন্যবাদ ঈশ্বর।’
ঘুমের মধ্যেই কনর শুনতে পেল।
‘কনর!’ কণ্ঠটা আরও তীব্র হচ্ছে, ‘কনর!’
নানুর কণ্ঠ।
কনর চোখ মেলে উঠে বসলো। রাত হয়ে গেছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে এখনও বাসার পেছনের পাহাড়ে আছে, ইয়ো গাছের মূলের ওপর শুয়ে আছে। ওপরে তাকিয়ে দেখলো এটা এখন কেবল একটা গাছ।
‘কনর!’
নানু তার দিকে চার্চের ওপাশ থেকে ছুটে আসছে। তার গাড়ি পার্ক করা, ইঞ্জিনটা এখনও চলছে। কনর বিরক্তি আর স্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
‘ওহ, ধন্যবাদ ঈশ্বর!’ নানু তার দিকে আসতে আসতে চিৎকার করে বললো।
এরপরই সে অবাক করার মতো একটা কাজ করলো।
সে ছুটে এসে কনরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন আরেকটু হলেই তারা পড়ে যাবে। কোনোমতে সামলে দাঁড়িয়ে থাকলো কনর। নানু চিৎকার করা শুরু করলো, ‘তুমি কোথায় ছিলে, কনর? আমি পাগলের মতো তোমাকে খুঁজছি। কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেছে, কী ভাবছিলে তুমি?’
‘আমার একটু কাজ ছিল।’ কনর বলতে শুরু করলো, কিন্তু নানু তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো ।
‘সময় নেই, আমাদের এখন যেতে হবে, এখনই।’
নানু তার হাত ছেড়ে দিয়ে গাড়ির দিকে ছুটলো, কনরও ছুটলো পেছন পেছন। গাড়িতে উঠতেই জোরে গাড়ি ছোটালো নানু। কনর এসবের কারণ জিজ্ঞেস করার মতো সাহস জোগাতে পারলো না ।
‘কনর!’ দ্রুত গাড়ি ছোটাতে ছোটাতে নানু বললো। কনর তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে সে কাঁদছে। ‘কনর তুমি–’ নানু স্টিয়ারিং হুইলটা খামচে ধরে রেখেছে।
‘নানু–’ কনর বলতে শুরু করলো।
‘না, কিছু বলবে না।’
তারা চুপচাপ চললো।
‘নানু?’ কনর কিছুক্ষণ পর আবার বললো।
নানু কিছু বললো না।
‘আমি দুঃখিত।’ কনর আস্তে করে বললো।
নানু যেন খুব কষ্ট করে হাসলো, ‘তাতে কিছু আসে যায় না, তাতে কিছু আসে যায় না।’
‘তাই?’
‘অবশ্যই।’ নানু আবার কাঁদতে শুরু করলো, কিন্তু সে তো কান্না করার মতো নানু না। ‘তুমি জানো, কনর, তুমি আর আমি, আমাদের একসাথে জমে না, তাইনা?’