‘গল্পটা শেষ হয়নি। সেটা বলে উঠলো।
‘আমাকে এখান থেকে বের করো।’ কনর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে।’
‘সেখানে আর কেউ নেই, কনর।’ আসল দানবটা বলে উঠলো, ‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘এটা কেবল একটা দুঃস্বপ্ন। এটা সত্যি না।’
‘এটাই সত্যি।’ দানবটা বললো, ‘তুমি জানো, তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘সে পড়ে গেছে।’ কনর বললো, ‘আমি তাকে ধরে রাখতে পারিনি, খুব ভারী হয়ে উঠেছিল।’
‘তাই তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’
‘সে পড়ে গিয়েছে!’ চিৎকার করে উঠলো কনর। সেই ভয়ানক দানবটা এখন ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এসেছে, তার গা থেকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে যে ধোঁয়ায় কনরের শ্বাস আটকে যাচ্ছে। যেন শ্বাস নিতেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার।
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা আবার বললো ।
‘আমি তাকে ছাড়িনি’ কনর কেঁদে উঠলো, ‘সে পড়ে গেছে!’
‘তোমাকে সত্যি কথাটা বলতে হবে, তা না হলে তুমি এই দুঃস্বপ্ন থেকে বের হতে পারবে না।’ দানবটার কণ্ঠ এখন যে-কোনো সময়ের চাইতে বেশি ভয়ানক শোনাচ্ছে, ‘তুমি আজীবন এখানে আটকে থাকবে।’
‘আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ!’ কনর পিছিয়ে গেল। দানবের তৈরি কুয়াশা তার পা পেঁচিয়ে ধরেছে, তাকে বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। ‘আমাকে সাহায্য করো!’
‘সত্যিটা বলো! সত্যিটা বলো, নাহয় সারাজীবন এখানে থাকো।’
‘কোন সত্যি?’ চিৎকার করে উঠলো কনর, ‘আমি জানি না তুমি কীসের কথা বলছো।’
‘তুমি জানো।’ হুমকির মতো শোনালো কথাটা
এরপর সব চুপ।
কনর জানে।
সে সব সময়ই জানতো।
সত্যিটা। দুঃস্বপ্নের সত্যিটা।
‘না, আমি পারবো না।’
‘তোমাকে পারতেই হবে।’
‘আমি পারবো না।’
‘তুমি পারবে, দানবের কণ্ঠ এখন দয়ালু শোনাচ্ছে।
চোখ ভিজে এলো কনরের। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে, নিজেকে সে থামাতে পারছে না।
‘প্লিজ আমাকে এটা বলতে বোলো না।’
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা বললো।
‘প্লিজ–‘
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো।’ দানবটা আবার বললো ।
এবার সে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
‘তুমি তাকে আরও ধরে রাখতে পারতে, কিন্তু তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো। তুমি
তাকে পড়ে যেতে দিয়েছো।’
আবার মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ করলো কনর। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
‘তুমি চাচ্ছো যেন সে পড়ে যাক। ‘
‘না!’ ভারী অশ্রুর মধ্য দিয়ে বললো কনর।
‘তুমি চেয়েছো যেন সে চলে যায়।’
‘না!’
‘তোমাকে এখন সত্যিটা বলতেই হবে, কনর ও’ম্যালি।’
কনরের বুক যেন জ্বলে যাচ্ছে। যেন কেউ জ্বলন্ত একটা সূর্য রেখে দিয়েছে তার
বুকের ভেতর। ভেতর থেকে সেটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
‘এমনটা করলে আমি মরে যাবো।’
‘এমনটা না করলেই তুমি মরে যাবে, তোমাকে বলতেই হবে।’
‘আমি পারছি না।’
‘তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছো, কেন?’
অন্ধকার চোখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, তার নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার, যেন মরে যাচ্ছে সে
‘কেন, কনর? বলো, কেন? দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বলো।’
বুকের ভেতরের আগুনটা যেন তাকে দ্রুত গ্রাস করে ফেলবে তাকে। এটাই সত্যি, সে জানতো এটাই সত্যি। তার মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এলো, সবকিছু যেন আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে। কনর যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো
আর এরপর সে সত্যিটা বললো।
চতুর্থ গল্পের বাকি অংশ।
‘কারণ আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।’ চিৎকার করে যেন তার ক্ষোভটা বেরিয়ে এলো, ‘সে চলে যাবে, এটা আমার সহ্য হচ্ছিল না! আমি চাচ্ছিলাম এসব শেষ হোক, কেবল শেষ হয়ে যাক!’
আর এরপর যেন আগুনে পৃথিবী ছেয়ে গেল। সবকিছু মুছে দিয়ে গেল। তাকেও যেন শেষ করে দিচ্ছে। কনর এই শাস্তিকে আমন্ত্রণ জানালো, অবশেষে সে তার পাওনা শাস্তিটা পাচ্ছে।
মৃত্যুর পরের জীবন
কনর চোখ মেলে দেখলো সে তার বাসার পেছনের পাহাড়ের ঘাসের ওপর শুয়ে আছে।
সে এখনও বেঁচে আছে।
‘এটা আমাকে মারেনি কেন?’ কনর গুঙিয়ে উঠলো, ‘সবচেয়ে খারাপটা আমার প্রাপ্য।’
‘তাই না-কি?’ দানবটা দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমি লম্বা সময় ধরে সেটাই ভেবে এসেছি।’ বলতেও কষ্ট হচ্ছে কনরের, ‘আমি সব সময়ই জানতাম সে সেরে উঠবে না, শুরু থেকেই সব জানতাম। সে বলেছে সে সুস্থ হয়ে উঠবে, কারণ আমি সেটা শুনতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আসলে করিনি।’
‘না।’ দানব বললো।
‘আর আমি ভাবতে শুরু করলাম যে আমি এসবের সমাপ্তি চাই। এ সমস্ত ভাবনার সমাপ্তি চাই। আমার আর সহ্য হচ্ছিল না।’
কনর এবার কাঁদতে শুরু করলো। সে হয়তো কখনও এত কাঁদেনি, প্রথমবার মায়ের রোগ ধরা পড়ার সময়ও এতটা কাঁদেনি।
‘আর মনের গহীনে কোথাও তুমি আশা করছিলে যেন এসব শেষ হয়ে যায়।।’ দানবটা বললো, ‘এর বিনিময়ে তাকে হারিয়েই-বা ফেলতে হোক না কেন।
কনর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
‘আর এরপর থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু, যার শেষ হয় সব সময়—’
‘আমি তাকে যেতে দিয়েছি। আমি ধরে রাখতে পারতাম, কিন্তু তাকে যেতে দিয়েছি।’
‘এবং এটাই হচ্ছে সেই সত্যিটা।’ দানবটা বললো।
‘আমি এমনটা চাইনি! আমি তাকে ছেড়ে দিতে চাইনি! এখন সে মারা যাবে। সব দোষ আমার।’
কনরের এখন শারীরিকভাবে কষ্ট হচ্ছে। পেশী টানটান হয়ে যাচ্ছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মাটিতে ঢুকে যেতে চাইলো সে আজীবনের জন্য।
দানবের বিশাল হাতটা তাকে দয়ালুভাবে তুলে নিলো, শাখা-প্রশাখা আর পাতা দিয়ে তাকে কিছুটা আরাম দেওয়ার চেষ্টা করলো ।