‘এখন সময় হয়েছে, চতুর্থ গল্পের।’ ইয়ো দানবটা বললো ।
‘আমি কোনো গল্প জানি না!’ কনর ভীত হয়ে বললো।
‘যদি তুমি না বলো, তাহলে তোমার হয়ে আমাকেই বলতে হবে।’ কনরকে নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে বললো, ‘আর বিশ্বাস করো, আমি বললে তুমি সেটা মোটেও পছন্দ করবে না।’
‘প্লিজ, আমাকে মায়ের কাছে যেতে হবে।’
‘কিন্তু’ দানবটা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সে তো ইতোমধ্যেই এখানে আছে।’
এ কথা বলেই হুট করে দানবটা তাকে নামিয়ে দিলো।
পায়ের নিচের ঠান্ডা মাটিটা তার পরিচিত। সে একটা পাহাড়ের ঢালে আছে, তার তিন দিক কালো জঙ্গলে ঘেরা, আর এক দিক ঢালের প্রান্ত যার পর কেবল অন্ধকার।
সেই ঢালের কাছে তার মা দাঁড়িয়ে আছে।
কনর তার পেছন দিক দেখতে পাচ্ছে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে কনরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসপাতালে থাকার সময়টার মতোই দুর্বল দেখাচ্ছে তাকে।
‘মা!’ চিৎকার করে উঠলো কনর, প্রচণ্ড ভারী লাগছে তার, যেমনটা এই দুঃস্বপ্নে সব সময়ই হয়, ‘ওখান থেকে সরে যাও।’
কিন্তু মা নড়লো না ।
কনর কোনোমতে নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলো, ‘মা, তোমাকে দৌড়ে পালাতে হবে।’
‘আমি ঠিক আছি সোনা, চিন্তা করতে হবে না।’
‘মা, দৌড়াও! প্লিজ দৌড়াও!’
‘কিন্তু সোনা এখানে
যেন কিছু একটা শুনে মা ঢালের নিচের দিকে তাকালো।
‘না।’ নিজে নিজেই বলে উঠলো কনর। সে টেনে-হিঁচড়ে আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু মা যেন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, অনেক সময় লেগে যাবে সেখানে পৌঁছতে, তার নিজেকে এত ভারী লাগছে
ঢালের নিচ থেকে চাপা একটা শব্দ এলো, গর্জন।
যেন বিশাল কিছু সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর চেয়েও বিশাল কিছু।
আর সেটা ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে।
‘কনর?’ মা আবার কনরের দিকে তাকালো।
কিন্তু কনর জানে, অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আসল দানব চলে আসছে।
‘মা!’ কনর চিৎকার করলো, কোনো এক অদৃশ্য ওজন যেন তাকে মাটিতে চেপে ধরেছে, ‘মা!’
গর্জনটা আরও তীব্র হচ্ছে, আরও তীব্র।
‘মা!’
সে জানে, সে সময়মতো সেখানে পৌঁছবে না ।
বিশাল এক গর্জন করে অতিকায় দুটো হাত ঢালের নিচ থেকে উপরে এগিয়ে এলো। মা ছুটে পালাতে চাইলো।
কিন্তু সে খুব দুর্বল, খুব বেশি দুর্বল।
হাত দুটো ভয়ানকভাবে আছড়ে পড়ে মাকে খপ করে ধরে ফেললো, আর টেনে নিচে নিয়ে যেতে থাকলো।
অবশেষে কনর উঠে দৌড় লাগালো, একটা চিৎকার করে ঢালের দিকে লাফিয়ে পড়লো।
নিজের হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরতে পেরেছে সে।
এই ছিল তার দুঃস্বপ্ন। যে দুঃস্বপ্নের কারণে সে প্রতি রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠতো। সেটা এখন হচ্ছে, এই তো, সেটা এখনই হচ্ছে।
ঢালের পাশে সে কোনোমতে তার মায়ের হাত ধরে আছে, সমস্ত শক্তি দিয়ে, যেন মা এই গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে না যায়, যেন এই দানবটা তাকে টেনে নিয়ে যেতে না পারে।
সে এখন দানবটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
আসল দানবটা, যে দানবটাকে সে সত্যিই ভয় পায়। যার কারণে সে ইয়ো দানবকে ভয় পায়নি। কালো মেঘ আর ছাইয়ের দানব। অসীম শক্তি আর লাল চোখ যা সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, ভয়ানক ধারালো দাঁত যেটা তার মাকে জীবন্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
‘আমি এর চেয়েও খারাপ কিছু দেখেছি।’ প্রথম রাতে কনর ইয়ো গাছকে বলেছিল।
আর এই সেই খারাপ জিনিসটা।
‘সাহায্য করো, কনর। আমাকে ছেড়ে দিও না।’ মা চিৎকার করে উঠলো।
‘আমি ছাড়বো না।’ কনরও চিৎকার করে বললো, ‘কথা দিচ্ছি।’
দুঃস্বপ্নের দানবটা গর্জে উঠে আরও জোরে তার মাকে টানতে লাগলো।
মা যেন ক্রমে পিছলে যাচ্ছে কনরের হাত থেকে।
‘না!’ মা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, ‘প্লিজ, কনর! আমাকে ধরে রাখো।’
‘রাখবো!’ কনর চিৎকার করে পেছনে ঘুরে ইয়ো গাছের দিকে তাকালো, যে কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে, ‘আমাকে সাহায্য করো! আমি ধরে রাখতে পারছি না!’
কিন্তু তা হলো না, ইয়ো গাছটা কেবল দেখতে লাগলো।
‘কনর!’ মা চিৎকার করে উঠলো।
তার হাত পিছলে যাচ্ছে।
‘কনর!’
‘মা!’ কেঁদে উঠলো কনর, আরও শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তার হাত ছুটে যাচ্ছে, মা যেন আরও ভারী হয়ে গেছে, দুঃস্বপ্নের দানবটা তাকে টেনে চলেছে।
‘আমি পড়ে যাচ্ছি!’ মা চিৎকার করে উঠলো।
‘না!’
কনর তাকে ধরে রাখতে গিয়ে নিজেই মুখ থুবড়ে পড়লো।
মা যেন অস্বাভাবিক রকম ভারী হয়ে গেছে।
‘প্লিজ!’ কনর নিজেকেই বললো,’ প্লিজ!’
ঠিক এ মুহূর্তে পেছন থেকে ইয়ো গাছটা বলে উঠলো, ‘চতুর্থ গল্পটা।’
‘চুপ করো, আমাকে সাহায্য করো!’
এটাই সত্যিটা, কনর ও’ম্যালি।
মা চিৎকার করছে, হাত পিছলে যাচ্ছে।
‘তোমাকে এখন ওই সত্যিটা বলতে হব।’ ইয়ো গাছ বললো।
‘না!’ কনরের গলা ভেঙে যাচ্ছে।
বলতেই হবে।
‘না!’
এরপর যেন সত্যিটা হুট করেই চলে এলো।
দুঃস্বপ্নটা যেন তার উপযুক্ত সময়ে পৌঁছে গেল
‘না!’
মা নিচে পড়ে গেল।
চতুর্থ গল্পের বাকি অংশ
এই সময়টাতে তার ঘুম ভেঙে গেল।
যখন মা চিৎকার করে তার হাত পিছলে নিচে গাঢ় অন্ধকারে পড়ে গেল, হারিয়ে গেল। এমন সময়ে সে জেগে ওঠে, ঘামে ভিজে, বুকের ধুকপুকানি নিয়ে
কিন্তু সে জেগে উঠলো না।
দুঃস্বপ্নটা এখনও তাকে ঘিরে রেখেছে। ইয়ো গাছ এখনও তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।