তারপর সে ঘড়ির দিকে তাকায়। স্কুলের জন্যে আরও পঁচিশ মিনিট পর বের হতে হবে। ইতোমধ্যে সে স্কুলের জামাও পরে নিয়েছে। দরজার কাছে স্কুলের ব্যাগটাও গুছিয়ে রাখা। এখন সে সবকিছু নিজে নিজেই করতে পারে।
রান্নাঘরের টেবিলে বসে জানালা দিয়ে চার্চটার দিকে তাকালো কনর। ওই তো ইয়ো গাছ।
সে সিরিয়াল খায় আর ভাবে-ওটা একটা স্বপ্ন, এছাড়া আর কিই-বা হতে পারে!
সকালে উঠে প্রথমেই জানালা দিয়ে পেছনের উঠোন দেখেছে সে। নাহ্, কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই। অবশ্যই কোনো ক্ষয়ক্ষতি থাকবে না। কেবল একটা ছোটো বাচ্চাই ওসব কিছু সত্যি বলে ভেবে নেবে। ভাববে যে একটা ইয়ো গাছ– একটা গাছ পাহাড় থেকে নেমে এসে তাকে আক্রমণ করেছিল।
ভাবতেই ওর হাসি পায়। কী বোকার মতো ভাবনা। তারপর সে বিছানা থেকে নেমে আসে। তখনই পায়ের নিচে মর্মর শব্দ তার মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পুরো ঘরজুড়ে ইয়ো গাছের পাতা।
আরেক চামচ সিরিয়াল সে মুখে নেয়। একবারও ময়লার ব্যাগের দিকে তাকালো না। সকালেই সে পাতাগুলো তুলে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়েছে।
রাতের বেলা নিশ্চয়ই অনেক বাতাস ছিল। হয়তো এ কারণে পাতাগুলো উড়ে
তার ঘরে এসেছে।
এটাই হবে।
সিরিয়াল আর টোস্ট শেষ করে সে জুসের গ্লাসে চুমুক দেয়। খাওয়া শেষ করে সে থালাবাসনগুলো ধুয়ে ডিশওয়াশারে রেখে দিলো। এখনও বিশ মিনিট বাকি। ভাবলো– ব্যাগটা বাইরে বড়ো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবে। যাচ্ছেই যেহেতু, ময়লার ব্যাগটাও নিয়ে যাবে। ওগুলো বাইরে রেখে এসে দেখলো, এখনও দশ মিনিট আছে। এখনও–
‘কনর?’ সিঁড়ির ওপর থেকে ডাকটা ভেসে আসে।
আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে।
‘নাস্তা করেছ?’ মা জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ মা।’ কনর উত্তর দিলো।
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ মা।’
মা তার দিকে একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। কনর চোখ পাকিয়ে বললো, ‘টোস্ট, সিরিয়াল আর জুস খেয়েছি। থালাবাসনগুলো ডিশওয়াশারে রেখে দিয়েছি আমি।’
‘আর ময়লাগুলোও ফেলে দিয়েছো।’ পরিষ্কার রান্নাঘর দেখে মা বললেন ।
‘আর ওয়াশিং মেশিনটাও চলছে।’
‘বাহ, গুড বয়।’ মুখে হাসি থাকলেও বিষণ্নতা লুকাতে পারলেন না মা, ‘সময়মতো উঠতে পারলাম না আজকে, সরি।’
‘ঠিক আছে।’
‘নতুন একটা রাউন্ডের—’
‘ব্যাপার না।’
মা কথা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসেন। আজ তিনি মাথায় স্কার্ফ বাঁধেননি, চুলবিহীন মাথাটা কেমন দুর্বল আর ভঙ্গুর দেখাচ্ছে। যেন একটা শিশুর মাথা। দেখে কনরের কষ্ট হচ্ছে।
‘কাল রাতে কি তুমি শব্দ করছিলে?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
কনর থমকে দাঁড়ালো। ‘কখন?’
‘মাঝরাতের পর। প্রথমে তো ভেবেছিলাম আমার মনের ভুল। কিন্তু স্পষ্ট তোমার কণ্ঠ শুনলাম।’
‘মনে হয় ঘুমের ঘোরে কথা বলছিলাম।’ নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয় কনর।
‘হয়তো। ও হ্যাঁ, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তোমার নানু আসছেন আগামীকাল।’
কনর বিরক্ত হলো, ‘উফ, মা।’
‘আমি জানি, কিন্তু তোমাকে এভাবে প্রতি সকালে একা একা নাস্তা বানাতে দেওয়া উচিত না।’
‘প্রতি সকালে? সে কয় দিন থাকবে?’
‘কনর–’
‘আমাদের তাকে দরকার নেই।’
‘কনর, চিকিৎসার এই পর্যায়ে আমার কী অবস্থা হয় তা তো তুমি জানোই– ‘
‘আমরা এতদিন পর্যন্ত ভালোভাবেই কাটাচ্ছিলাম না?’
‘কনর!’ মা রেগে গেলেন। মায়ের কণ্ঠ এতটাই রুক্ষ হয়ে ওঠে যে দুজনেই চমকে যায়। অনেকক্ষণ দুজনের মধ্যে নীরবতা কাজ করে। মা শেষমেশ হেসে ফেললেন।
‘আমি চেষ্টা করবো যেন খুব তাড়াতাড়িই এসব শেষ হয়, ঠিক আছে?’ মা বললেন, ‘আমি জানি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও ঘুমাতে অনেক খারাপ লাগে আর আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। দরকার না পড়লে তো আমি তাকে ডাকতাম না, তাই না?’
নানু এলে সবসময় কনরকে সোফায় ঘুমাতে হয়। কিন্তু সমস্যা সেটা না। নানু যেভাবে তার সাথে কথা বলে, সেটা কনরের পছন্দ না। মনে হয় যেন কোনো কর্মচারীকে সিধা করার চেষ্টা করছেন তিনি। মহিলার মন জোগানোর কোনো পথ সে খুঁজে পায় না। এতদিন তো দুজনের ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। হ্যাঁ, মায়ের ট্রিটমেন্টই এমন যে অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য মাকে কষ্ট সহ্য করতে হবেই। তাহলে?
‘কেবল কিছুদিনের জন্যে, ঠিক আছে?’ মা বললেন।
কনর কিছু না বলে স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিতেই প্লাস্টিকের ব্যাগের কথা মনে পড়লো।
ওর ঘরের দখল নানুর কাছে যাওয়াকে খুব একটা মন্দ কিছু মনে হচ্ছে না এখন। ‘এই তো, এই হাসিটাই আমি ভালোবাসি।’ মা একটু ঠাট্টা করে বলেন, ‘মা নাকি আমার জন্যে উইগ আনছে কতগুলো। আমাকে তো জম্বি মার্গারেট থেচারের মতো দেখাবে।’
‘আমার ফিরতে দেরি হবে।’ কনর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো।
‘ঠিক আছে, সোনা।’ মা কনারের কপালে চুমু খেলেন, ‘তুমি খুব লক্ষ্মী। মাঝেমধ্যে মনে হয় এত লক্ষ্মী না হলেও খুব একটা সমস্যা ছিল না।’
স্কুলে যাওয়র আগে মায়ের চায়ের কাপটা সিংকের ওপর রেখে বের হওয়ার সময় মাকে নিজের সাথেই কথা বলতে শুনলো, ‘ওই তো পুরোনো ইয়ো গাছ।’
স্কুল
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কনর তার মুখে রক্তের নোনা স্বাদ পেল। মাঠে পড়ে যাওয়ার সময় তার ঠোঁট ভেতর দিকে কেটে গেছে। রক্তের এই ধাতব স্বাদ খুবই জঘন্য, থুথু ফেলে সাথে সাথে মুখ থেকে দূর করতে ইচ্ছা হয়–এমন একটা স্বাদ।