তাদের কথা হয়ে গেছে।
আর কিছু বলার নেই।
‘কনর?’ নানু দরজার সামনে এসে ডাকলো ।
‘আমি বাসায় যাবো।’ কনর উত্তর দিলো।
‘কনর–’
‘আমার বাসা।’ কনর মাথা তুলতেই দেখা গেল তার চোখগুলো লাল হয়ে আছে, দুঃখে, লজ্জায়, ক্ষোভে, ‘যে বাসায় ইয়ো গাছ আছে।’
তোমার প্রয়োজন কী আর?
‘আমি আবার হসপিটালে যাছি, কনর।’ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নানু বললো, ‘আমার তাকে এভাবে একা রেখে আসতে ভালো লাগে না, তোমার এত কী প্রয়োজন ছিল বাসায়?’
‘একটা দরকারি কাজ আছে আমার।’ কনর তার বাসার দিকে তাকিয়ে আছে, যে বাসায় সে তার পুরোটা জীবন কাটিয়েছে। খুব বেশিদিন হয়নি এখান থেকে চলে যাওয়ার, কিন্তু এটাকে এখন আর আগের মতো আপন লাগছে না ।
হয়তো এটা আর কখনও তার নিজের বাসার মতো মনে হবে না ।
‘আমি এক ঘণ্টা পর এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।’ নানু বললো, ‘তারপর আমরা ডিনার করবো।’
কনর সে-সব কিছুই যেন শুনলো না, গাড়ির দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল সে।
‘এক ঘণ্টা।’ নানু আবার বললো, ‘আজ রাতে তোমার সেখানে থাকা দরকার।‘
কনর তার বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
‘কনর?’ পেছন থেকে ডাকলেও নানুর দিকে সে ফিরে তাকালো না ।
সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
বাসার ভেতরে বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। ভেতরে ঢুকে দরজাও বন্ধ করলো না কনর। সোজা রান্নাঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো।
পাহাড়ের ওপর চার্চটা, আর তার পাশের কবরস্থানে ইয়ো গাছটা।
পেছনের উঠান পেরিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে এল সে। রেললাইনের কাঁটাতারের ভেতর দিয়ে বের হওয়ার সময় তার শার্ট ছিঁড়ে গেল, কিন্তু কনর সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না। কোনো ট্রেন আসছে কি না সেটাও দেখে নিলো না। আরও একটা বেড়া পেরোনোর পর সে চার্চে এসে পড়লো। এরপর সোজা চলে গেল কবরস্থানে, চোখটা এখনও গাছের ওপর স্থির।
সেটা এখনও একটা গাছ হয়েই আছে।
কনর এবার ছুটতে শুরু করলো।
‘ওঠো!’ সেখানে পৌঁছানোর আগেই কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘ওঠো!’
মূলের কাছে এসে লাথি কষতে শুরু করলো, ‘আমি বলছি জেগে ওঠো! সময় হয়েছে কি না তাতে কিছু যায় আসে না, জেগে ওঠো!’
আরও জোরে লাথি কষতে থাকলো কনর।
আরও একবার ।
ইয়ো গাছটা এত দ্রুত সরে গেল যে কনর তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।
‘এমন করতে থাকলে তুমি নিজেরই ক্ষতি করে ফেলবে।’ দানবটা বলে উঠলো।
‘সেটা কাজ করেনি!’ কনর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো, ‘তুমি বলেছিলে সেটা কাজ করবে, কিন্তু করেনি।’
‘আমি বলেছিলাম যদি তোমার মাকে সুস্থ করা যায়, তবে ইয়ো গাছ তা করবে। বোঝা যাচ্ছে তোমার মাকে সুস্থ করা যাবে না।’
রাগে যেন কনরের বুক কেঁপে উঠলো। সে দানবটার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, খামচে তার ছালবাকল তুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো, ‘সুস্থ করো, সুস্থ করে তোলো তাকে!
‘কনর!’ দানবটা বলে উঠলো।
‘আর প্রয়োজন কী তোমার, যদি তাকে সুস্থই না করতে পারো?’ কনর সরে গিয়ে বললো, ‘বিরক্তিকর গল্প শোনাও আর আমাকে বিপদে ফেল। সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমার কোনো রোগ হয়েছে—’
দানবটা তাকে হাতে তুলে নিতেই সে থেমে গেল।
‘তুমি আমাকে ডেকে জীবন্ত করেছো কনর, ও’ম্যালি। এসব প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দেবে।’
‘আমি যদি তোমাকে ডেকে থাকি’ কনরের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, যেন তার চোখ বেয়ে রাগ গড়িয়ে পড়ছে, ‘তবে সেটা আমার মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য।’
‘আমি তাকে সুস্থ করতে আসিনি, আমি তোমাকে সুস্থ করতে এসেছি।’
‘আমাকে?’ কনর হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ করে দিলো, ‘আমাকে সুস্থ করতে হবে না, আমার মা–’
কথাটা বলতে পারলো না সে। যত যাই হয়ে থাকুক না কেন, সে বলতে পারবে না। সে নিজে আগে থেকে জেনে থাকলেও না। হ্যাঁ, সে জানতো, সে আগে থেকেই জানতো, কিন্তু তাও সে বলতে পারবে না ।
কনর কাঁদছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তার শরীর কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।
সে দানবের দিকে তাকালো, ‘আমাকে সাহায্য করো!’ খুব আস্তে করে বললো কথাটা।
‘এখন সময় হয়েছে, চতুর্থ গল্পের।’
কনর চিৎকার করে উঠলো, ‘না! এখন এসবের চেয়েও জরুরি কিছু আছে!’
‘হ্যাঁ, আছে।’
দানবটা তার খোলা হাত মেলে ধরলো।
সাথে সাথে তাদের চারপাশটা আবার কুয়াশায় ছেয়ে গেল।
এবং আরও একবার, তার সেই দুঃস্বপ্নে এসে পড়লো।
চতুর্থ গল্প
দানবের বিশাল ভারী হাতটা কনরকে জাপটে ধরে রাখার পরও আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরলো। অন্ধকারটা যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে আর তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে—
‘না!’ কনর চিৎকার করে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু দানবটা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, ‘না, প্লিজ!’
পাহাড়, চার্চ, কবরস্থান সবই হারিয়ে গেছে, কেবল একটা ঠান্ডা অন্ধকার। এই অন্ধকারটা আগেও কনর অনুভব করেছে, যখন মাকে প্রথমবারের মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর আগে যখন চিকিৎসার কারণে মায়ের চুল পড়ে যেত, তারও আগে যখন মায়ের ফ্লু সারতোই না, এর আগে যখন মা ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তারও আগে। তারও অনেক আগে যেন চিরকাল ধরে এই অন্ধকার অনুভব করে আসছে সে। দুঃস্বপ্নটা কখনোই তার পিছু ছাড়েনি, তাকে একা করে দিয়েছে এটা।
এই দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু সে বুঝি কখনো দেখেইনি।
‘আমাকে এখান থেকে বের করো।’ সে চিৎকার করে উঠলো, ‘প্লিজ!’