তারা দুজনেই কনরের দিকে তাকালো।
একশো বছর
নানু মায়ের হসপিটালের রুমের সামনে এসে থেমে গেল।
‘তুমি ভেতরে আসবে না?’ কনর জিজ্ঞেস করলো ।
নানু মাথা নাড়লো, ‘আমি ওয়েটিং রুমে থাকবো।’ বলে সে কনরকে একা রেখে চলে গেল।
ভেতরে কী দেখবে তা ভেবে কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। এর আগে কখনোই তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হয়নি, এমনকি ইস্টারের সময়ও না।
প্রশ্নের বন্যা বয়ে যাচ্ছে তার মাথায়।
প্রশ্নগুলো সে উপেক্ষা করে গেল।
মনে আতঙ্ক নিয়ে দরজাটা খুললো সে।
কিন্তু তার মা জেগে আছে, বিছানায় বসে আছে। সে হাসছে। এক মুহূর্তের জন্য কনরের বুক ধক করে উঠলো। চিকিৎসা মনে হয় কাজ করেছে। ইয়ো গাছ তাকে সারিয়ে তুলেছে। দানবটা কাজ করেছে
তারপরই সে দেখলো মায়ের হাসিটা তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সে কনরকে দেখে খুশি হয়েছে, কিন্তু নিজেও ভয় পাচ্ছে। এখনও অনেক বেশি ক্লান্ত।
‘হ্যালো, বাবা।’ তার গলার কণ্ঠটা ভারী।
কনর বুঝতে পারছে সে ধীরে ধীরে রেগে উঠছে।
‘এদিকে এসো।’ মা বিছানায় বসে ইশারা করে বললো।
কনর সেখানে বসলো না, পাশের একটা চেয়ারে বসলো।
‘কেমন আছো, সোনামণি?’ গতকালের চেয়েও তার কণ্ঠ বেশি ক্লান্ত। আজ যেন একটু বেশিই টিউব লাগানো হয়েছে। তার মাথায় স্কার্ফটা নেই। ঘরের আলোতে মাথার চামড়াটা চকচক করছে। কনরের ইচ্ছা করলো কিছু একটা দিয়ে সেটা ঢেকে দেয়।
‘কী হয়েছে? নানু আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলো কেন?’
‘আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আর যেভাবে ওষুধের কারণে আমাকে বারবার ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে, তাতে আমি পরে আর সুযোগ পাবো কি না তা বুঝতে পারছিলাম না।’
‘তুমি সন্ধ্যাবেলা মাঝে মাঝে জেগে ওঠো, আমাকে তো রাতের বেলায় দেখতে পারতে।’
কনর জানে সে একটা প্রশ্ন করছে, সে এটাও জানে যে মাও তা জানে।
‘আমি তোমাকে এখনই দেখতে চেয়েছিলাম, কনর।’ মা বললো। সাথে সাথেই তার চোখ ভিজে উঠলো।
‘কথা বলার সময় হয়েছে, তাই না?’ কনর ধারালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কি—’
বাক্যটা শেষ করতে পারলো না সে।
‘আমার দিকে তাকাও।’ কনর মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার সে চোখ তুলে তাকালো। মায়ের মুখে প্রচণ্ড ক্লান্ত এক হাসি। বালিশগুলো মাথার দিকে এমনভাবে রাখা যেন মা নিজে মাথা তুলে রাখতে পারে। বিছানাটাও এমনভাবে বাঁকানো যেন সে কনরের দিকে তাকাতে পারে।
মা বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো, ‘আমি আজ সকালে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।’ তার কণ্ঠ খুবই দুর্বল, ‘নতুন চিকিৎসাটা কাজ করছে না, কনর। ‘
‘ইয়ো গাছেরটা?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন কাজ করছে না?’
‘সবকিছু খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল, আশাটাও খুব কম ছিল, আর এখন ইনফেকশনের জন্য–‘
‘কিন্তু কেন কাজ করছে না?’ কনর যেন অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করলো।
‘আমি জানি, প্রতিদিন গাছটা দেখে আমার মনে হতো সে আমার দুঃসময়ের বন্ধু। ‘
‘কিন্তু সে সাহায্য করলো না।’
মা মাথা নাড়লো। তার চেহারায় একটা উদ্বিগ্নতার ছাপ। কনর বুঝতে পারলো এই উদ্বিগ্নতা আসলে কনরের জন্য।
‘তো এখন কী হবে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, ‘এখন আর কী চিকিৎসা দেবে?’ মা উত্তর দিলো না। এই নীরবতা নিজেই যেন একটা উত্তর।
কনর কিছুটা জোরেই স্বগতোক্তি করলো, ‘আর কোনো চিকিৎসা নেই।
‘আমি দুঃখিত, বাবা।’ মায়ের চোখে পানি, ‘জীবনে কখনও আমার এতটা খারাপ লাগেনি।’
পুনরায় মেঝের দিকে তাকালো কনর। মনে হচ্ছে তার শ্বাস যেন আটকে গেছে, ‘তুমি বলেছিলে, এটা কাজ করবে।’ তার গলা ভেঙে আসছে।
‘আমি জানি।’
‘তুমি বলেছিলে, তোমার বিশ্বাস–এটা কাজ করবে।’
‘আমি জানি।’
‘তুমি মিথ্যা বলেছো, তুমি পুরোটা সময় মিথ্যা বলে এসেছো।’
মা তার দিকে হাত বাড়ালো, কিন্তু কনর সরে গেল।
‘তুমি মিথ্যা বলেছো।’
‘আমার মনে হয়, অন্তরের গহিনে তুমি সব সময় এটা জানতে, তাই না?’ মা জিজ্ঞেস করলো।
কনর কোনো উত্তর দিলো না ।
‘তোমার রাগ ঠিক আছে সোনামণি, সত্যিই ঠিক আছে।’ মা মৃদু হাসলো, ‘আসলে আমিও খুব রেগে আছি। কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি বলতে চাই, মন দিয়ে শোনো। তুমি কি শুনছো?’
তার দিকে হাত বাড়ালো মা। কনর তার হাতে হাত রাখলো, রাখতেই বুঝতে পারলো তার হাতটা খুবই দুর্বল।
‘তোমার যত ইচ্ছা তুমি রাগ করতে পারো, যে যাই বলুক না কেন। তোমার বাবা, তোমার নানু–কারও কথাই শুনবে না। কোনো কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করলে ভেঙে ফেলো। কারও কথা শুনবে না।’
কনর তার দিকে তাকাতে পারছিল না।
‘আর যদি কোনো দিন’ এবার মা কেঁদে উঠলো, ‘মনে হয় যে এতটা রাগ করা ঠিক হয়নি, যদি কোনো দিন মনে হয় যে তুমি আমার সাথে আর কথা বলতে পারবে না, কনর, তাহলে তুমি জেনে রেখো যে সেটাই ঠিক। আমি জানতাম। ঠিক আছে? তুমি না বললেও আমি সব জানতাম, ঠিক আছে?’
কনর এখনও তার দিকে তাকাতে পারছে না, মাথা তুলতে পারছে না, খুব ভারী লাগছে।
সে কেবল হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো।
কনরের এ মুহূর্তে নিজেকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। ‘দুঃখিত সোনা, আমার এখন পেইনকিলার লাগবে।’ মা বললো।
তার হাত ছেড়ে দিলো কনর। মা ওষুধগুলো নিয়ে নিলো।
‘আমার কাছে যদি একশো বছর থাকতো’ মা বললো, ‘যদি একশো বছর থাকতো আমার কাছে, তবে আমি তা পুরোটাই তোমাকে দিয়ে দিতাম।’
কনর উত্তর দিলো না। কয়েক মুহূর্ত পরেই মা ঘুমে ঢলে পড়লো।