হেডমিস্ট্রেস তাঁর ভারী চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘স্কুলের নিয়ম অনুসারে তোমাকে এখনই বের করে দেওয়ার কথা ।‘
পেট মোচড় দিয়ে উঠলো কনরের। মনে হচ্ছে তার শরীর থেকে বাড়তি কিছু ওজন কমে গেছে। এরপর সে বুঝতে পারলো কমে গেছে, কারণ তার ওপর থেকে ভারটা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাবনাটা যেন তাকে স্বস্তি এনে দিলো। তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। অবশেষে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। এখন সবকিছু আবার অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে। শাস্তি আসছে তার।
ধন্যবাদ ঈশ্বর। ধন্যবাদ ঈশ্বর।
‘কিন্তু সেটা কীভাবে করি?’ হেডমিস্ট্রেস বললেন।
কনর জমে গেল।
‘এটা করলে আমি নিজেকে একজন শিক্ষক বলে কীভাবে ভাববো? তোমার এমন অবস্থায় তোমাকে বের করে দিতে পারি না। হ্যারির ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই জানি। একদিন আমাদের এসব নিয়ে কথা বলতে হবে, কনর ও’ম্যালি। বলতেই হবে।’ তিনি ডেস্কের ওপর থেকে কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে থাকলেন, ‘কিন্তু সেই দিনটা আজকে নয়।’ শেষবারের মতো কনরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এর চেয়েও গুরুতর জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে।’
কনরের এক মুহূর্ত লাগলো এটা বুঝতে যে এখন আর কিছু হবে না। এটুকুই। ‘আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না?’
হেডমিস্ট্রেস একটা বিষণ্ন হাসি হাসলেন, খুব দয়ালু ভঙ্গিমায় বাবার মতো করেই বললেন, ‘তাতে কীই-বা হবে?’
মিস ওয়ান তাকে ক্লাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।
সে ক্লাসে আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেল। এমনকি শিক্ষকও কোনো কথা বললো না। নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়েই সে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। তার পেছনে ডেস্কে বসা লিলিকে দেখে মনে হলো সে কিছু বলবে, কিন্তু বললো না।
বাকি সারা দিন কেউ কিছু বললো না তাকে।
‘অদৃশ্য হওয়ার চেয়েও কঠিন কিছু আছে।’ দানবটা বলেছিল। ওটা সঠিক কথাই বলেছিল।
এখন আর অদৃশ্য নেই কনর। সবাই তাকে দেখছে।
কিন্তু এখন যেন সে আরও বেশি হারিয়ে গেছে।
একটি চিঠি
কিছু দিন গেল। এরপর আরও কিছু দিন গেল। কত দিন গেছে তা বলা শক্ত, সবগুলো দিনই কনরের কাছে ধূসর দিন। সে সকালে ওঠে। নানু তার সাথে কথা বলে না, এমনকি হেডমিস্ট্রেসের ফোনের ব্যাপারেও কিছু বলেনি। সে স্কুলে যায় এবং সেখানেও কেউ তার সাথে কথা বলে না। সে মাকে দেখতে হাসপাতালে যায়, কিন্তু মা এতই ক্লান্ত থাকে যে কথা বলতে পারে না। বাবা ফোন করে, কিন্তু তাকে বলার মতো কিছু নেই।
দানবটাও আর আসছে না, হ্যারির ঘটনার পর থেকে আর আসছে না। যদিও এখন কনরের গল্প বলার সময় হয়ে গেছে। প্রতিরাতে কনর অপেক্ষা করে, কিন্তু সেটা আসে না। হয়তো সেটা বুঝে গেছে যে কনর সত্যি বলবে না, সত্যিটা জানলেও বলতে অস্বীকার যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে, আর দুঃস্বপ্নটা দেখে। এখন যেন প্রতিবারই ঘুমানোর পর দুঃস্বপ্নটা আসে। আগের চেয়েও খারাপভাবে। এক রাতে প্রায় তিন-চারবার সে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এত জোরে চিৎকার করে যে নানু দৌড়ে এসে দেখে যায় সব ঠিক আছে কি না ।
সপ্তাহের ছুটিগুলো হাসপাতালে কাটে। মায়ের নতুন ওষুধগুলো কাজ করতে সময় লাগছে, আর সেই সময়ের মধ্যে তার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়ে যাচ্ছে। তার ব্যথাগুলো বেড়ে যাচ্ছে, বেশিরভাগ সময় তাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হচ্ছে।
মাঝে মাঝে লিলি আর তার মা আসে, কিন্তু তারা আসার পুরোটা সময় কনর গিফট শপে বসে ম্যাগাজিন পড়ে কাটিয়ে দেয়।
এরপর সে আবারও স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সবকিছু যেন নিজস্ব গতিতেই চলছে। পৃথিবীর কোনো কিছুই থেমে নেই।
মিস মার্ল সবাইকে জীবনগাথা হোমওয়ার্কের খাতা ফিরিয়ে দিচ্ছিল, যাদের প্রত্যেকের জীবন আছে। কনর কেবল তার ডেস্কে বসে থাকে, ঘড়ির দিকে তাকায়। বারোটা সাত বাজতে এখনও আরও আড়াই ঘণ্টা বাকি। যদিও তাতে কিছু আসে যায় না। দানবটা হয়তো চিরতরে চলে গেছে।
আর কেউ তো তার সাথে কথা বলবে না।
‘এই!’ কেউ যেন ফিসফিসিয়ে তাকে বলছে।
লিলি তার পাশের ডেস্কে বসে আছে। বারবার মিস মার্লের দিকে লক্ষ রাখছে। তার হাতে একটা চিঠি।
কনরের জন্য একটা চিঠি।
‘এটা নাও।’ লিলি লাজুকভাবে বললো।
কনর দেখে নিলো মিস মার্ল দেখছে কি না। মিস মার্ল এখন সালির জীবনগাথা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে ব্যস্ত। কনর চিঠিটা নিলো।
মনে হচ্ছে এটাকে একশোবার ভাঁজ করা হয়েছে। সে লিলির দিকে একটা বিরক্তিকর চাহনিতে তাকালো; লিলি অবশ্য এখনও টিচারকে দেখার অভিনয় করছে।
কনর চিঠিটা পুরোপুরি মেলে ধরলো। কেবল চারটা বাক্য লেখা।
চারটা বাক্য, আর যেন পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘সবাইকে তোমার মায়ের কথা বলে দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।’ প্রথম বাক্য।
‘তোমার বন্ধুত্বটা আমার খুব মনে পড়ে।’দ্বিতীয় বাক্য।
‘তুমি ঠিক আছো?’তৃতীয় বাক্য।
‘আমি তোমাকে দেখি।’চতুর্থ বাক্য।
লেখাগুলো বারবার পড়লো কনর।
আবার লিলির দিকে তাকালো। মিস মার্ল তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু কনর বুঝতে পারলো তার মুখের এই চাপা হাসিটা মিস মার্লের প্রশংসার কারণে নয়।
মিস মার্ল চলে গেলে লিলি তার দিকে তাকালো, একেবারে চোখের দিকে। সে সত্যি কথাই বলেছে। লিলি তাকে দেখতে পায়, সত্যিই দেখতে পায়। কনর ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো, ‘লিলি-’ কিন্তু দরজা খুলে স্কুলের সেক্রেটারি এলো, সঙ্গে মিস মার্লও আছে।