‘আর খুব মজার একটা বিষয় আছে। মনে আছে, আমাদের বাসার পেছনে পাহাড়ে একটা ইয়ো গাছ আছে?’
কনরের চোখ বড়ো হয়ে গেল।
‘বিশ্বাস করবে কি না জানি না, তবে এই ওষুধটা সেই ইয়ো গাছ থেকে বানাবে।
‘ইয়ো গাছ?’
‘হ্যাঁ, আমি প্রথম দিকেই এর ব্যাপারে পড়েছিলাম।’ মা একটু কাশলো, ‘মানে, আমি ভাবিনি কখনো এতদূর আসতে হবে, কিন্তু এখন ভাবতে অবাক লাগছে যে এত দিন আমরা আমাদের বাসা থেকে যেই ইয়ো গাছ দেখতাম সেটাই এখন আমাকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে।’
কনরের চিন্তাভাবনা যেন ঝড়ের বেগে দৌড়াতে শুরু করেছে। এত জোরে যে তার মাথা ঘুরে উঠলো।
‘এ জগতের সবুজ জিনিসগুলো খুব দারুণ, তাই না?’ মা বলতে লাগলো, ‘আমরা সেগুলোকে কীভাবে ধ্বংস করে ফেলি! কিন্তু সেই জিনিসগুলোই মাঝে মাঝে আমাদেরকে বাঁচিয়ে তোলে।’
‘এটা তোমাকে বাঁচাবে?’
মা আবার হাসলো, ‘আমার সেটাই বিশ্বাস। ‘
এমন হতে পারে?
কনর হাসপাতালের করিডোর দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল, তার চিন্তাগুলো যেন ঝড়ের বেগে ছুটছে। ইয়ো গাছ দিয়ে বানানো ওষুধ, এমন ওষুধ যেটা রোগ সারিয়ে তুলতে পারে। এমন ওষুধ যেটা বানাতে এপথকেরি সেই লোকটাকে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। যদিও কনর এখনও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে না যে ওই লোকের বাসাটা কেন ভেঙে ফেলা হয়েছিল।
হয়তো দানবটা এখানে কোনো একটা কারণে এসেছে। হয়তো সে কনরের মাকে বাঁচানোর জন্য জীবন্ত হয়েছে।
আশা করতেও যেন ভয় পেল কনর।
না।
অবশ্যই না। এটা সত্যি হতে পারে না। দানবটা একটা স্বপ্ন, এ সবকিছুই একটা স্বপ্ন।
কিন্তু সেই পাতাগুলো, সেই বেরিগুলো, মেঝেতে ফুলে ওঠা মূলগুলো আর নানুর বসার ঘরের সেই ধ্বংসযজ্ঞ!
হুট করে কনরের খুব হালকা অনুভব হলো, যেন সে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে।
এমনটা হতে পারে? এমনটা সত্যিই কি হতে পারে?
করিডোরের শেষ মাথায় শব্দ শোনা গেল। তার বাবা আর নানু ঝগড়া করছে। কী বলছে তা শোনা যাচ্ছে না, তবে নানু বাবার দিকে রেগেমেগে আঙুল তুলে কথা বলছে।
‘তো তুমি আমাকে কী করতে বলো?’ তার বাবা বললো। আশপাশের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নানুর উত্তর শুনতে পেল না কন। রেগেমেগে নানু করিডোর থেকে তার মায়ের রুমের দিকে চলে গেল, একবারের জন্যও সে কনরের দিকে তাকায়নি।
একটু পরেই বাবা এগিয়ে এলো।
‘কী হয়েছে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘তোমার নানু আমার ওপর রেগে আছে, নতুন কিছু না।’
‘কেন রেগে আছে?’
‘কিছু খারাপ খবর আছে, কনর। আমাকে আজই চলে যেতে হবে।’
‘আজই? কেন?’
‘বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘ওহ্! কী হয়েছে?’
গুরুতর কিছু না, কিন্তু স্টেফানি পাগলামি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, আর বলছে যেন আমি এখনি ফেরত যাই।’
‘আর তুমি চলে যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি আবার আসবো। পরের রবিবারে, দুই সপ্তাহ লাগবে না, আমাকে তার চেয়ে বেশি বন্ধ দিয়েছে।’
‘দুই সপ্তাহ!’ কনর যেন নিজেকেই বললো, ‘কিন্তু ঠিক আছে। মাকে নতুন ওষুধ দেওয়া হবে যেটা তাকে সুস্থ করে তুলবে, তত দিনে তুমি যদি ফেরত আসো
বাবার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে সে কথা বলা থামিয়ে দিলো।
‘চলো, আমরা একটু হেঁটে আসি।’ বাবা বললো ।
হসপিটালের পাশেই একটা পার্ক আছে। কনর আর তার বাবা একটা খালি বেঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হসপিটালের গাউন পরা কিছু রোগীকে হাঁটাহাঁটি করতে দেখলো। এছাড়াও রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদেরও হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যাচ্ছে। পার্কটাকে এখন হসপিটালের মতোই মনে হচ্ছে।
‘আমরা এখন কথা বলবো, তাই না?’ বসতে বসতে বললো কনর, ‘সবাই যেন আমার সাথে আজকাল কথাই বলতে চায়।’
‘কনর, এই নতুন ওষুধটা–’
‘এটা তাকে সারিয়ে তুলবে।’ জোর দিয়ে বললো কনর।
‘না কনর, হয়তো করবে না।’
‘না, করবে।’
‘এটা শেষ চেষ্টা, বাবা। আমি খুবই দুঃখিত, কিন্তু দ্রুতই সব এগিয়ে যাচ্ছে।’
‘এটা তাকে সুস্থ করে তুলবে, আমি জানি।’
‘কনর, তোমার নানু আরও একটা কারণে আমার ওপর রেগে আছে। তার ধারণা,
আমি বা তোমার মা কেউই তোমাকে আসল কথাটা বলছি না।’
‘নানু এসব ব্যাপারে কতটুকু জানে?’
বাবা তার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘কনর, তোমার মা–’
‘ঠিক হয়ে যাবে।’ কনর হাতটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ‘এই নতুন ওষুধটা গোপনীয়। এর একটা কারণ আছে, আর আমি সেটা জানি।’
‘কীসের কারণ?’
‘তুমি আমেরিকায় তোমার আরেক পরিবারের কাছে ফেরত যাও, আমরা তোমাকে ছাড়াই ঠিক থাকবো। কারণ এটা কাজ করবে।’
‘কনর, না–’
‘হ্যাঁ, এটা করবে।’ বলে কনর হাঁটতে শুরু করলো।
‘বাবা, সব গল্পের সব সময় সুখের সমাপ্তি হয় না। ‘
এটা শুনে সে থেমে গেল। আসলেই? এই একটা জিনিসই দানবটা তাকে শিখিয়েছে। গল্প বুনো জিনিস, কখন কোথায় চলে যায় সেটা আগে থেকে ঠাহর করা যায় না।
‘তোমার ওপর দিয়ে অনেককিছু যাচ্ছে, আমি জানি। এসব অন্যায়, খুব কষ্টকর। এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।’
কোনো উত্তর দিলো না কনর।
‘আমি এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসবো, সেটা মনে রেখো। ঠিক আছে?’ কনর উপরে সূর্যের দিকে তাকালো, অক্টোবরের হিসেবে উষ্ণ একটা দিন। ‘কত দিন থাকবে?’ সে জিজ্ঞেস করলো।
‘যত দিন থাকা যায়।‘
‘আর এরপর আবার চলে যাবে।’
‘যেতেই হবে, আমার–‘
‘আরও একটা পরিবার আছে।’ কনর বাক্যটা শেষ করলো।
বাবা তার হাত ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার আগেই কনর হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।