‘অন্য সবকিছু বলতে মাকে বোঝাচ্ছো?’
‘তোমার নাস্তা শেষ করো।’
‘তুমি আমাকে শাস্তি দেবে না?’
‘তাতে লাভ কী, কনর?’ বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘তাতে কীই-বা লাভ হবে?’
-০-
কনর তার ক্লাসে কিছুই শুনছে না, অথচ শিক্ষকেরা তাকে এসবের বিপরীতে কিছুই বলছে না।
ম্যাডাম তো তাকে জীবনগাথা হোমওয়ার্কের কথা আর জিজ্ঞেস করেনি। একটা বাক্যও লেখেনি কনর। তাও সে কিছু বলেনি।
যদিও তাতে কিছু আসে যায় না।
তার বন্ধুরা তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, যেন তার শরীরে দুর্গন্ধ। সকাল থেকে এ পর্যন্ত কারো সাথে সে কথাও বলেনি। তার মানে, সকালে বাবা তাকে নামিয়ে দেওয়ার পর থেকে এখনও সে কারো সাথে কথা বলেনি।
এমন কিছু কীভাবে হতে পারে?
কিন্তু অবশেষে, হ্যারি, সালি আর অ্যান্টন তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই তার কাছে স্বাভাবিক।
‘ও’ম্যালি!’ হ্যারি বললো। তার পেছন পেছন সালি ও অ্যান্টন হাসছে।
কনর দেয়াল থেকে উঠে দাঁড়ালো। নিজেকে একটা ঘুসির জন্য প্রস্তুত করলো।
কিন্তু সেটা এলো না।
হ্যারি দাঁড়িয়ে আছে। অ্যান্টন আর সালিও দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাসি আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে।
‘কীসের অপেক্ষা করছো?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
‘হ্যাঁ’ সালি হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কীসের অপেক্ষা করছো?’
‘মারো ওকে।’ অ্যান্টন বললো।
হ্যারি নড়লো না। কেবল কনরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কনরও তাকিয়ে আছে। যেন এই জগতে এখন তারা ছাড়া আর কেউ নেই। কনরের হাত-পা ঘেমে যাছে।
‘করে ফেল।’ কনর জোরে বললো।
‘কী করবো, ও’ম্যালি?’ হ্যারি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করতে বলছো আমাকে?’
‘ওকে পিটুনি দিতে বলছে।’ সালি বললো।
‘ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে বলছে।’ অ্যান্টন বললো।
‘তাই না-কি? তুমি কি তাই চাও ও’ম্যালি?’
কনর কিছু বললো না। কেবল হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে রইলো।
অপেক্ষা করছে।
এরপরই বেল বেজে গেল, আর মিস ওয়ান আরেকজন শিক্ষকের সাথে কথা বলতে বলতে মাঠে চলে এলো, আড়চোখে তাকালো হ্যারি আর কনরের দিকে।
‘হয়তো কখনোই জানা যাবে না’ হ্যারি বললো, ‘ও’ম্যালি আসলে কী চায়।’ অ্যান্টন আর সালি হেসে উঠলো, যদিও তারা কিছুই বোঝেনি।। কনরকে একা রেখে ওরা তিনজন ভেতরে চলে গেল।
যেন সে পুরো জগতের কাছে অদৃশ্য।
ইয়ো গাছ
‘হ্যালো সোনামণি।’ কনরকে দরজা দিয়ে আসতে দেখে মা বিছানায় উঠে বসলো ।
কনর বুঝতে পারলো উঠে বসতে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে।
‘আমি বাইরে আছি।’ বলে নানু তার দিকে না তাকিয়েই বাইরে চলে গেল।
‘আমি দেখি ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিছু পাই কি না, স্পোর্ট।’ বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বললো, ‘তুমি কিছু চাও?’
‘আমি চাই তুমি আমাকে স্পোর্ট বলা বন্ধ কর।’ কনর তার মায়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললো। মা হাসতে লাগলো।
‘একটু পরে আসছি,’ বলে বাবা কনরকে ওর মায়ের সাথে একা ছেড়ে চলে গেল। ‘এদিকে এসো।’ মা তার বিছানার পাশে বসতে ইশারা করলো। কনর খুব সাবধানে মায়ের নাক থেকে বের হওয়া দুটো টিউবকে এড়িয়ে সেখানে গিয়ে বসলো।
‘আমার কনর কেমন আছে তাহলে?’ তার মাথায় হাত বুলিয়ে মা জানতে চাইলো। কনর দেখলো তার মায়ের কনুইয়ের দিকের জায়গাটা বেগুনি হয়ে গেছে। ওখানেই দুটো টিউব ঢোকানো হয়েছে। মা অবশ্য হাসছে। ক্লান্ত, কিন্তু হাসছে।
‘আমি জানি আমাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে।’
‘না, দেখাচ্ছে না।’ কনর বললো।
মা আবার তার আঙুল দিয়ে কনরের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো, ‘এ-রকম দয়ালু মিথ্যাকে মাফ করে দেওয়া যায়।’
‘তুমি ঠিক আছো?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, যদিও সে জানে এটা খুব বাজে একটা প্রশ্ন। কিন্তু মা জানে সে কী জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে।
‘সোনামণি, তারা কিছু নতুন জিনিস চেষ্টা করে দেখেছে, সেগুলো এখনও কাজ করছে না। অতিশীঘ্রই করবেও না হয়তো। এসবের কোনো মানে আছে?’
কনর মাথা নাড়লো।
‘আমারও মনে হয়, নেই।’ কনর দেখলো মা জোর করে হাসার চেষ্টা করছে। বড়ো একটা শ্বাস নিতেই যেন মায়ের বুক কেঁপে উঠলো।
‘আমি যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে হয়তো এখন দ্রুতই হবে সব।’ মায়ের কণ্ঠটা খুব ভারী, এতটাই ভারী যে কনরের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। সকালে নাস্তা না খেয়ে এখন মনে হচ্ছে ভালোই করেছে সে।
‘কিন্তু’ মায়ের গলা এখনও ভারী, তারপরও সে হাসছে, ‘তারা আরও একটা জিনিস চেষ্টা করতে পারে, একটা ঔষধ যেটার ফলাফল খুব ভালো হয়।’
‘তারা সেটা আগে চেষ্টা করেনি কেন?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘মনে আছে, আমার সব চিকিৎসায় কীভাবে আমার চুল পড়ে যেত, আর খালি বমি হতো?’
‘অবশ্যই।’
‘সে-সবে কাজ না হলে এটা চেষ্টা করা হয়। একটা সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যায়, তবে তারা চাচ্ছে যেন ওটা একদম শেষেই করা হয়।’ মা মেঝের দিকে তাকালো, ‘তারা চাচ্ছিল যেন শেষ চেষ্টাটা এত দ্রুত না করতে হয়।
‘মানে কী? খুব দেরি হয়ে গেছে?’ কনর বুঝে ওঠার আগেই প্রশ্নটা করে ফেলল। ‘না, কনর।’ মা খুব তাড়াতাড়ি উত্তর করলো, ‘এভাবে ভেবো না, খুব দেরি হয়ে যায়নি। কখনোই খুব দেরি হয়ে যায় না।’
‘তুমি নিশ্চিত?
মা আবার হাসলো, ‘আমি তাই বিশ্বাস করি।’ এবার তার কণ্ঠটা একটু দৃঢ়।
কনরের দানবটার কথা মনে হলো, বিশ্বাসেই অসুস্থতা অর্ধেক কেটে যায় ।
তার মনে হলো যেন সে শ্বাস নিতে পারছে না, কিন্তু তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। সেটা বুঝতে পেরে মা তার বাহুতে হাত বুলিয়ে দিলো।