‘হায় ঈশ্বর!’ বুকের ধুকপুকানি এতই বেড়ে গেছে যেন তার হৃদপিণ্ড বেরিয়ে চলে আসবে।
সামনের দরজা খুলে নানু ঘরে এলো।
ব্যাগ থেকে চাবি বের করতে করতে আশপাশে তাকিয়ে সবকিছু বুঝতে তার কিছু সময় লেগে গেল। কনর তার চেহারায় ক্লান্ত ভাব দেখলো। অন্যরকম কিছু নেই সেই চেহারায়, কেবল অন্যান্য দিনের মতোই একটা ক্লান্তিভাব।
‘এসব কী–’ বাক্যটা শেষ করতে পারলো না সে।
নানু থমকে দাঁড়িয়েছে। কেবল তার চোখ দুটো ঘরের এই ধ্বংসস্তূপের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন তারা বিশ্বাস করতে পারছে না এখানে কী ঘটে গেছে। কনর নানুর শ্বাস-প্রশ্বাসও শুনতে পেল না।
নানু হাঁ করে তার দিকে তাকালো। রক্তমাখা হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে।
এবং এরপরই নানু গুঙিয়ে উঠলো।
শব্দটা যেন খুবই পীড়াদায়ক। কনরের মনে হলো হাত দিয়ে দু-কান চেপে ধরে।
নানু আবার শব্দটা করলো, এবং আবারও এবং আবারও, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা বিভীষিকার শব্দ হয়ে উঠলো। সে হাত দিয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। শব্দগুলো থামানোর চেষ্টা করতে থাকলো, কিন্তু পারলো না।
‘নানু?’ কনর নিজেই আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো।
এরপর নানু চিৎকার করে উঠলো।
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। এত জোরে চিৎকার করলো যে এবার কনর সত্যিই তার কান দু-হাতে চেপে ধরলো। নানু তার দিকে তাকাচ্ছে না। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। শুধু চিৎকার করে কাঁদছে।
এরপর সে ঘরে ঢুকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো। কনর দুই হাত দিয়ে যেন নিজেকে বাঁচাতে চাইলো।
কিন্তু নানু তাকে মারতে আসছে না।
সে দ্রুত কনরের পাশ কাটিয়ে ডিসপ্লে ক্যাবিনেটের সামনে চলে গেল। তার চোখে অশ্রু, আর সে চিৎকার করে কাঁদছে এখনও। ক্যাবিনেট থেকে জিনিসগুলো বের করলো।
তারপর সেগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো।
নানু একবারও কনরের দিকে তাকালো না। শেষবারের মতো একটা চিৎকার দিয়ে উপরে চলে গিয়ে তার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কনর, সে বুঝতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত।
যেন অনন্তকাল পর সে সেখান থেকে নড়ে রান্নাঘর থেকে কিছু প্লাস্টিকের ব্যাগ এনে ঘরের জিনিসগুলো সেটাতে ভরে ফেলতে লাগলো। সব পরিষ্কার করতে প্রায় পুরো রাত লেগে গেল। ভোর হয়ে যাচ্ছে, সে আর পেরে উঠছে না।
ময়লা আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তগুলো না ধুয়েই কনর সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় নানুর ঘরের দিকে তাকালো, সেখানে এখনও বাতি জ্বলছে।
নানুর কান্না শোনা যাচ্ছে।
অদৃশ্য
কনর স্কুলমাঠে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ আগে সে লিলিকে দেখেছে। যে-সব মেয়েকে লিলি এমনিতে পছন্দ করে না, তাদের সাথেই দেখেছে। ও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। কনর তার চোখে পড়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু লিলি তার দিকে তাকায়নি। যেন সে কনর কে দেখতে চাচ্ছে না।
এসব কারণে কনর একা একা দাঁড়িয়ে আছে। অন্য ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করছে। নিজেরা খেলাধুলা করছে, আর নিজেদের ফোন দেখছে। যেন এ জগতে যাই হোক না কেন, তা থেকে তারা মুক্ত।
এমন সময় কনর হ্যারি আর তার চ্যালাপ্যালাকে দেখতে পেল। তারা কনরের দিকেই আসছে। হ্যারির চোখে একটা উৎসুক দৃষ্টি
এই তো তারা আসছে।
কনর যেন স্বস্তি পেল।
-০-
এই সকালে সে দুঃস্বপ্নটা দেখার জন্যই ঘুমিয়ে ছিল। সেই দুঃস্বপ্নটা, সেই আতঙ্ক আর পড়ে যাওয়া, যার শেষে ভয়ানক এক সমাপ্তি। সে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল।
সাহস জুগিয়ে নিচে গিয়ে দেখলো তার বাবা নানুর রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাচ্ছে। নানুকে কোথাও দেখা গেল না।
‘ডিম ভাজি খাবে?’ বাবা জিজ্ঞেস করলো।
কনর মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললো, যদিও তার মোটেও ক্ষুধা নেই। বাবা তাকে ভাজা ডিম আর মাখন দিয়ে টোস্ট বানিয়ে দিলো। এরপর তারা একসাথে সকালের নাস্তা করলো। ওদের মাঝে এমন নীরবতা নেমে এলো যে কনরের দমবন্ধ হয়ে আসতে
লাগলো।
‘ভালোই ধ্বংসযজ্ঞ করেছো তুমি। তোমার নানু আমাকে সকালে ফোন করেছে, অনেক সকালে।’ বাবা বললো।
কনর চুপচাপ তার ডিমটা খেয়ে নিলো।
‘তোমার মায়ের অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে, কনর। তোমার নানু হসপিটালের ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে। আমি তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসবো এখন।’
‘স্কুল?’ কনর জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো!’
‘কিন্তু’ বাবা মাথা নাড়লো, ‘সেখানে এখন কোনো বাচ্চার যাওয়া উচিত নয়, আমি তোমাকে স্কুলে দিয়ে এখন হাসপাতালে যাবো আর স্কুল শেষ হলেই তোমাকে নিতে আসবো। এরপর তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। দরকার পড়লে আগেই চলে আসবো।’
কনর তার কাটা চামচ আর ছুরিটা নামিয়ে রাখলো, খেতে ইচ্ছে করছে না আর। হয়তো আর কখনও ইচ্ছে করবে না।
‘এই’ বাবা বললো, ‘মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে সাহসী হতে হবে? তোমাকে সেটা এখনই করতে হবে।’ বাবা বসার ঘরের দিকে তাকালো, ‘আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমার নানুরও হচ্ছে।’
‘আমি এসব করতে চাইনি, আসলে কী হয়েছে তা নিজেই বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে।’ তার বাবা বললো ।
‘ঠিক আছে?’ কনর ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘এসবের ব্যাপারে ভেবো না, এর চেয়েও খারাপ কিছু হয়।’
‘মানে কী?’
‘এর মানে, আমরা এ সবকিছু ভুলে যাবো। যেন এসব কখনও হয়নি, যেমনভাবে অন্য সবকিছু উপেক্ষা করে যাচ্ছি।’