পাশের ইয়ো গাছটাও দেখতে পাচ্ছে কনর। গোরস্থানের একদম মাঝামাঝি গাছটার অবস্থান। গাছটা সম্ভবত এই চার্চ তৈরি করার আগ থেকেই এখানে আছে। সে জানে এটা ইয়ো গাছ, কারণ ছোটোবেলায় তার মা এটা বলে দিয়েছিলেন যে সে যেন ভুলেও এ গাছের ফল না খায়। ফলগুলো না-কি বিষাক্ত।
আবার কেউ ডাকছে তাকে।
‘কনর।’
যেন এইমাত্র তার কানে ফিসফিসিয়ে ডাকলো ।
‘কী?’ কনর অধৈর্য হয়ে বলে। ওর বুক ধুকপুক করছে।
চাঁদের সামনে মেঘ জমে চারপাশ আরও অন্ধকার হয়ে গেল। পাহাড় থেকে এক পশলা দমকা বাতাস ভেসে আসে তার ঘরে। কাঠ মোচড়ানোর অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। যেন পৃথিবীর আজ ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে, তার ক্ষুধার্ত পাকস্থলীর রাগী গর্জন।
আস্তে আস্তে মেঘ সরে যেতেই আবার চাঁদ দেখা গেল। ইয়ো গাছের ওপর চাঁদের আলো পড়েছে। গাছটি এখন তার বাসার পেছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই সেই দানব
কনর দেখলো গাছের ওপরের দিকের শাখা-প্রশাখাগুলো মিলে ভয়ানক একটা চেহারার অবয়ব নিয়েছে, সেখানে মুখ, নাক আর একজোড়া চোখ দেখা যাচ্ছে যা সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বিশাল বড়ো বড়ো দুটো শাখা মিলে সেটার হাতের আকার নিয়েছে। গাছের বাকি অংশ থেকে মেরুদণ্ড, বুক আর শরীরের অন্যান্য অংশগুলো গড়ে উঠেছে। গাছের চিকন পাতাগুলো চামড়ার কাজ করছে। দানবটা এমনভাবে শ্বাস নিচ্ছে যেন ওর সত্যিকারের ফুসফুস আছে।
কনরের জানালার চেয়েও লম্বা দানবটার আকৃতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওটার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। কনরের দিকে তাকিয়ে আছে সেটা, নিঃশ্বাসের সাথে তীব্র বাতাসের শব্দ। হাত দুটো জানালার দুই পাশে রেখে সেটা নিচু হয়ে ঝুঁকে কনরের দিকে তাকায়। এর বিশাল ওজনে তার ঘরটা দুলছে।
দানবটা কথা বললো,
‘কনর ও’ম্যালি।’ একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল তার নিঃশ্বাসের সাথে। কর্কশ আর ভয়ানক শব্দটায় কনরের বুক কেঁপে উঠলো।
‘আমি তোমাকে নিতে এসেছি কনর ও’ম্যালি।’ বলেই দানবটা পুরো বাড়িটাকে ঝাঁকুনি দেয়। কনরের দেয়ালের ছবিগুলো মাটিতে খসে পড়ে। শেলফের বই, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আর পুরোনো গন্ডারের পুতুলটাও মাটিতে আছড়ে পড়ে।
একটা দানব–কনর ভাবে। সত্যিকারের দানব। পুরোটাই বাস্তব, স্বপ্ন না। ওর জানালার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে নিয়ে যেতে এসেছে। কিন্তু কনর ভয় পেয়ে দৌড় দেয় না। সত্যি বলতে কি, তার একটুও ভয় করেনি। বরং সে কিছুটা হতাশ। কারণ সে এমন দানব আশা করেনি।
‘তাহলে এসে আমাকে নিয়ে যাও।’ সে বললো।
চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে।
‘কী বললে তুমি?’ দানবটা জিজ্ঞেস করে।
‘আমি বলেছি, আমাকে নিয়ে যাও।’
দানবটা এক মুহূর্ত চুপ থেকে গর্জে উঠে জানালায় বিশাল হাত দুটো দিয়ে আঘাত করলো। কনরের বাসার ছাদ এই আঘাতে বাঁকলের মতো উঠে এলো। দেয়ালের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁটল দেখা দিলো। ঘরের ভেতর দমকা বাতাস ছুটোছুটি করছে। দানবের ঘুসির কারণে বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে যাচ্ছে।
‘যতই চেষ্টা করো, আমি ভয় পাবো না। এর চেয়ে বাজে জিনিস আমি দেখেছি।’
দানব আরও জোরে গর্জে ওঠে। জানালা আর দেয়ালের মধ্য দিয়ে দানবটা হাত ঢুকিয়ে দেয়ায় সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করে। কনর বুঝতে পারে আঁকাবাঁকা শিকড়বাকর তাকে আঁকড়ে ধরেছে। ওকে বের করেই দানব সাঁই করে ঘুরে দাঁড়ায়। যেন চাঁদের সাথে ওকে আঁটকে ফেলেছে দানবটি। ওটা কনরকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন যে-কোনো মুহূর্তে ওর বুকের পাঁজর ভেঙে যাবে। শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দানবটি মুখ হাঁ করতেই কনর ওর শিকড় দিয়ে পাকানো দাঁতগুলো দেখতে পায়। দানবের নিঃশ্বাসের সাথে উষ্ণ বাতাস বের হয়ে আসছে।
দানব এবার থেমে যায় ।
‘তুমি আসলেই আমাকে ভয় পাচ্ছ না?’
‘না।’ কনর বলে, ‘তোমাকে ভয় পাবো কেন?
দানবটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।
‘তুমি আমাকে ঠিকই ভয় পাবে।’ দানবটি বলে, ‘শেষে ঠিকই ভয় পাবে।’
শেষ দৃশ্যটায় কনর যা দেখতে পেল-দানবটি তাকে জীবিত খেয়ে ফেলার জন্য হাঁ করে এগিয়ে আসছে।
সকালের নাস্তা
‘মা।’ কনর রান্নাঘরে ঢুকেই ডাক দেয়।
সে জানে এখন মাকে এখানে পাওয়া যাবে না। কেটলিতে পানি গরম করার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। মা রান্নাঘরে এলে সবার আগে এই কাজটাই করে। আজকাল যে কোনো ঘরেই মাকে পাওয়া যায়। বাড়ির যে-কোনো জায়গায় মা ঘুমিয়ে পড়ে। তাই এখন কোনো ঘরে প্রবেশ করার আগে সে নিশ্চিত হয়ে নেয় মা আছে কি না।
আপাতত মা রান্নাঘরে নেই। তার মানে সে নিশ্চয়ই নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। অর্থাৎ কনরকে এখন সকালের নাস্তা নিজেই বানিয়ে নিতে হবে। এই ব্যাপারটার সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যাক, ব্যাপার না। অন্তত আজকের সকালে তার কিছুটা ভালো লাগছে।
সে দ্রুত ময়লা পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়ে। রুম থেকে নিয়ে আসা প্লাস্টিকের ব্যাগভর্তি ময়লা আরেকটা বড়ো পলিথিনের ব্যাগে ভরে নেয়। তারপর ওটার ওপর আরও ময়লা ঢেলে দেয় যাতে কেউ বুঝতে না পারে নিচে কী আছে।
‘এই তো হয়ে গেছে।’ আনমনে বলে সে, ‘এখন নাস্তা।’
টোস্টারে সে কয়েকটা রুটি গরম করে নিলো। এরপর একটা বোলে সিরিয়াল ঢেলে গ্লাসে জুস ঢেলে নেয়। রান্নাঘরের টেবিলে বসেই নাস্তা সেড়ে নেয়। মায়ের জন্যে আলাদা সিরিয়াল আর সুপের ব্যবস্থা আছে। শহরের হেলথ ফুড শপ থেকে মা ওগুলো আনানোর ব্যবস্থা করে। ভাগ্য ভালো কনরকে ওসব খাবার খেতে হয় না, স্বাদহীন অসুখী কিছু খাবার।