সেকেন্ডের কাঁটা ভেঙে ঘড়ি থেকে পড়ে গেল।
কনর পেন্ডুলামটা ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল। সেটা আর দুলছে না, ঘড়িটাও আর শব্দ করছে না। যেন পুরোটাই জমে গেছে।
হায় হায়।
কী করেছে তা বুঝতে পেরে তার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।
হায় হায়! সে ভাবলো!
সে এটা ভেঙে ফেলেছে।
ঘড়িটার দাম হয়তো তার মায়ের গাড়ির চেয়েও বেশি। নানু তাকে খুন করে
ফেলবে। মহিলা তাকে আসলেই মেরে ফেলবে।
কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারলো।
ঘণ্টার কাঁটা ও মিনিটের কাঁটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে আটকে গেছে।
১২টা বেজে ৭ মিনিট।
‘ধ্বংস’ দানবটা তার পেছন থেকে বললো, ‘খুবই পীড়াদায়ক।’
কনর ঘুরে তাকালো। কোনোভাবে দানবটা তার নানুর বসার ঘরে চলে এসেছে। সে এখনও বিশালাকৃতির। তাই ঝুঁকে থাকতে হচ্ছে। শাখা-প্রশাখা আর পাতাগুলো কুঁচকে আছে। পুরোটা ঘর তার শরীর দখল করে রেখেছে।
‘ছোটো একটা ছেলের কাছ থেকে এই ধরনের ধ্বংসই আশা করা যায়।’ দানবটার নিঃশ্বাসে কনরের চুল উড়ছে।
‘তুমি এখানে কী করছো?’ কনর জিজ্ঞেস করলো। হুট করে যেন তার মনে আশা দানা বেঁধে উঠলো, ‘আমি কি ঘুমিয়ে আছি? এটা কি কোনো স্বপ্ন?’
‘আমি তোমাকে দ্বিতীয় গল্প শোনাতে এসেছি।’ দানবটা বললো।
কনর ঘুরে ভাঙা ঘড়িটার দিকে তাকালো, ‘এই গল্প কি আগের গল্পের মতোই বাজে হবে?’
‘এটা পুরোপুরি ধ্বংসের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।’
কনর ঘুরে দানবটার দিকে তাকালো। অভিব্যক্তিটা দেখে মনে হলো দানবের মুখে শয়তানি হাসি।
‘এটাও কি কোনো ধোঁকাবাজির গল্প?’ জিজ্ঞেস করলো, ‘শুরুতে মনে হবে এক রকম আর শেষ হবে একদম অন্যরকমভাবে, সেরকম কিছু?’
‘না।’ দানবটা বললো, ‘এটা এমন এক লোকের গল্প যে কেবল নিজের ব্যাপারে ভাবতো।’ দানবটা আবারো হাসছে। এবার তাকে আরও বেশি ভয়ানক দেখাচ্ছে, ‘এবং তাকে খুব খুব খারাপভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।’
কনর এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ভাঙা ঘড়িটার কথা ভাবলো। সোফার নিচে দাগ পড়ে যাওয়া মেঝের কথা ভাবলো, দানবের গা থেকে ঝরে পড়া বিষাক্ত বেরির কথা ভাবলো।
নিজের বাবার কথা ভাবলো।
‘আমি শুনছি।’ কনর বললো।
দ্বিতীয় গল্প
‘একশ পঞ্চাশ বছর আগের কথা’ দানব বলতে শুরু করলো, ‘এই দেশটা তখন ব্যবসায়ীদের দেশ হয়ে গিয়েছিল। তামাক চাষের মতো কলকারখানার চাষ হতে শুরু করেছিল। গাছ কাটা হচ্ছিল, মাঠ ভরে ফেলা হচ্ছিল আর নদীগুলো ছোটো হয়ে আসছিল। আকাশে তখন ধোঁয়ার ছড়াছড়ি, আর মানুষ তখন কাশতে কাশতে দিন কাটাতো। তাদের চোখ জ্বরের কারণে লাল হয়ে থাকতো। গ্রাম শহরে পরিণত হলো, আর শহরগুলো আরও বড়ো শহরে পরিণত হতে থাকলো। আর এদিকে মানুষ তখন পৃথিবীতে নয়, বরং পৃথিবীর উপরে বসবাস করতে লাগলো।
কিন্তু দেখার মতো চোখ থাকলে তখনও সবুজ দেখা যেত।
দানব আবার তার বিশাল হাত মেলে ধরায় নানুর বসার রুম কুয়াশায় ছেয়ে গেল। যখন কুয়াশা সরে গেল, তখন কনর এবং দানবটা একটা সবুজ মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে দূরে ইট আর লোহার নানান স্থাপনা দেখা যাচ্ছে।
‘আমি তাহলে ঘুমাচ্ছি।’ কনর বললো।
‘চুপ।’ দানবটা বললো, ‘এই যে সে আসছে।’ কনর দেখতে পেল একটা তেতো মুখের ভারী কালো জামা পরা একটা লোক ভ্রু কুঁচকে পাহাড় থেকে নেমে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
এই সবুজের মাঝে একটা লোক থাকতো। তার নাম জানা জরুরি নয়, কারণ সে নামে তাকে কখনও কেউ ডাকেনি। গ্রামবাসীরা তাকে এপথকেরি নামে ডাকত ।
‘কী নামে?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
‘এপথকেরি নামে।’ উত্তর দিলো দানবটা।
‘কী?’
এপথকেরি মানে হচ্ছে গিয়ে একজন রসায়নবিদ। আদিম যুগে এটাই ডাকা হতো তাদের।
‘ওহ্, তো এভাবে বললেই তো হয়।’ কনর বললো।
নামের সার্থকতা ছিল কারণ এপথকেরিরা ঔষধ বানানোর জন্য পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতো। গাছের ছালবাকল আর বেরির রস দিয়ে নানান ওষুধ বানাতো।
‘বাবার নতুন বউ এটাই করে।’ লোকটাকে একটা গাছের মূল কর্তনরত অবস্থায় দেখতে দেখতে কনর বললো, ‘তার ক্রিস্টালের দোকান আছে।’
দানবটা ভ্রু কুঁচকালো, ‘দুটো এক জিনিস নয়।’
এপথকেরি মাঝেমধ্যেই ঔষধি গাছ সংগ্রহ করর জন্য বনের মধ্যে যেত। কিন্তু কিছু সময় পরেই বনগুলো ছোটো হতে শুরু করে। কলকারখানাগুলোও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এপথকেরি তাই দরকারি জিনিসপত্র ঠিকমতো খুঁজে পেত না, ফলে তার চিকিৎসাপদ্ধতির অবনতি হতে থাকলো। এমন একটা সময়ে এলো যখন সামান্য বেলা রোজা খুঁজে পাবার জন্য তার সারা দিন চলে যেত।
পৃথিবী বদলে যাচ্ছিল, আর এপথকেরি আরও তেতিয়ে উঠছিল। অথবা এমনও হতে পারে যে সে সব সময়ই একজন তেতো লোক ছিল। লোকটা ছিল খুবই লোভী, মাঝেমধ্যে সে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতো। যাই হোক, গ্রামবাসীরা তাকে পছন্দ করতো না দেখে সে খুব অবাক হতো। হয়তো ভাবছো–সে তাদেরকে চিকিৎসা প্রদান করছে, তার বিনিময়ে এতটুকু সম্মান তার প্রাপ্য। তার ব্যবহারের কারণেও রোগীরা তাকে পছন্দ করতো না এবং এমন একটা সময় এলো যখন রোগীরা চিকিৎসার জন্য আধুনিক পদ্ধতি এবং আধুনিক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে শুরু করলো। ফলস্বরূপ এপথকেরি আরও বেশি তেতিয়ে উঠলো।
তাদেরকে চারপাশ থেকে আবারও কুয়াশা ঘিরে ধরলো। এখন তারা একটা ছোটো পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে বিশাল এক ইয়ো গাছের নিচে একটা লোক বসে আছে।