‘এসব ব্যাপারে হয়তো তার সাথে কথা বলা যেতে পারে। ওখানে তো অনেকগুলো ঘর আছে। তোমার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে।’
‘আমি ওখানে আমার ব্যবস্থা করতে চাই না।’ কনরের গলার স্বর খানিক উঁচু হয়ে গেল। ‘আমি আমার নিজের বাসায় আমার নিজের ঘর চাই।’
‘আমেরিকায় তো তুমি তা পাবে না, কনর। আমাদের তিনজনের জন্যই যথেষ্ট জায়গা নেই। তোমার নানুর কাছে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা এবং টাকা আছে। তাছাড়া তোমার স্কুল এখানে, বন্ধু-বান্ধব এখানে, তোমার পুরো জীবনই এখানে। তোমাকে সে-সব থেকে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
‘কার জন্য ঠিক হবে না?’
‘আমি সেভাবে বলতে চাইনি, আমি বলতে চাচ্ছি যে তোমাকে সাহসী হতে হবে।
‘সবাই এটাই বলে, যেন এটা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমি দুঃখিত, এসব তোমার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে, কিন্তু আমি সত্যিই চাই যে এমনটা না হতো–’
‘আসলেই কি তা চাও?’
‘অবশ্যই’ বাবা টেবিলের দিকে ঝুঁকে বললো, ‘কিন্তু এভাবেই সবার জন্য ভালো হবে, তুমি পরে বুঝতে পারবে।’
কনর বাবার দিকে না তাকিয়েই বললো, ‘মা ঠিক হয়ে গেলে কি আমরা এসব নিয়ে কথা বলতে পারি?’
বাবা আবার তার চেয়ারে ঝুঁকে গেল, ‘অবশ্যই, বাড়ি। আমরা সেটাই করবো।’ কনর এবার তার দিকে তাকালো, ‘বাড়ি?’
‘সরি!’ বাবা হাসলো। গ্লাসটা নিয়ে আমোদে একটা চুমুক দিলো। এরপর কনরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘গাছের ব্যাপারে কী বলছিলে?’
ঠিক তখনই ওয়েটার তাদের পিজা নিয়ে এলো।
‘আমেরিকানো।’ কনর ভ্রু কুঁচকে তাকালো, ‘এটা কথা বলতে পারলে হয়তো তোমার মতোই কথা বলতো।’
আমেরিকানরা খুব বেশি ছুটি পায় না
‘তোমার নানুর বাসার মতো দেখাচ্ছে না এখনও।’ বাবা রেন্টাল গাড়িটা নানুর বাসার সামনে পার্ক করতে করতে বললো।
‘আমি ঘুমিয়ে গেলে সে মাঝে মাঝে হাসপাতালে চলে যায়।’ কনর বললো, ‘নার্সরা তাকে চেয়ারে ঘুমাতে দেয়।’
‘সে হয়তো আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু তার মানে এই না যে সে খারাপ মহিলা।’ বাবা বললো ।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাসাটার দিকে তাকালো কনর। ‘তুমি কত দিন আছো?’ সে জিজ্ঞেস করলো। এতক্ষণ জিজ্ঞেস করতে ভয় করছিল।
বাবা এমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যেন একটা দুঃসংবাদ আসছে, ‘মাত্র কয়েকদিন।’
কনর তার দিকে তাকালো, ‘এটুকুই?’
‘আমেরিকানরা খুব একটা বন্ধ পায় না।’
‘কিন্তু তুমি তো আমেরিকান নও।’
‘কিন্তু আমি আমেরিকায় থাকি।’ বাবা হাসছে, ‘তুমি নিজেই তো সারা রাত আমাকে আমার কথার ভঙ্গির জন্য খেপালে।’
‘তুমি তাহলে কেন এসেছো? আসার দরকারই-বা কী?’
বাবা উত্তর দেওয়ার আগে একটু চুপ করে রইলো, ‘আমি এসেছি, কারণ তোমার
মা আমাকে আসতে বলেছে।’ মনে হলো বাবা আরও কিছু বলবে, কিন্তু বললো না।
কনর নিজেও কিছু বললো না।
‘আমি আবার আসবো’ তার বাবা বললো, ‘যখন প্রয়োজন হবে। আর তুমি ক্রিসমাসে আমাদের ওখানে আসবে, খুব মজা হবে।’
‘তোমার সেই গাদাগাদি করা বাসায় যেখানে আমার জন্য জায়গা নেই?’ কনর বললো।
‘কনর–’
‘আর তারপর আমি স্কুলের আগেই চলে আসবো’
‘কনর–’
‘তুমি কেন এসেছো?’ কনর গলার স্বর নিচু করে আবার জিজ্ঞেস করলো। এবার বাবা উত্তর দিলো না। গাড়ির ভেতরজুড়ে নিস্তব্ধতা। যেন তারা কোনো ক্যানিয়নের অপর পাশে বসে আছে। বাবা এক হাত বাড়িয়ে কনরের ঘাড়ে হাত রাখলো। কিন্তু কনর দরজা খুলে বের হয়ে গেল ।
‘কনর, দাঁড়াও।’
কনর দাঁড়ালো, কিন্তু ফিরে তাকালো না।
‘তুমি কি চাও তোমার মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরা পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকি?’
‘আমি নিজে নিজেই ঠিক আছি।’
বাসায় ঢোকার পর বাসাটা খুব চুপচাপ মনে হলো। হবেই না কেন? সে তো একা।
দামি সোফাটায় ধরাম করে বসে পড়তেই একটা শব্দ হলো। শব্দটা তার ভালো লেগেছে, সে উঠে আবার ধরাম করে বসলো। এবার উঠে সেটার ওপর লাফাতে থাকলো, সোফার কাঠের পায়াগুলো মচমচ করছে, মেঝেতে সেগুলোর দাগ পড়ে যাচ্ছে।
নিজে নিজে হাসলো কনর। এমন করতে ভালো লাগছে।
সে সোফা থেকে নেমে সেটাতে একটা লাথি মারলো। তার নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। কপাল গরম হয়ে গেছে। সম্ভবত জ্বর এসেছে। আরও একটা লাথি মারলো সোফাটায়।
এবার ঘড়ির দিকে তাকালো। তার নানুর দামি ঘড়ির পেন্ডুলামটা আপন মনে এদিক-ওদিক দুলছে। যেন কনরকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।
সে আস্তে আস্তে সেটার দিকে এগিয়ে গেল। একটু পরেই বংবং শব্দ করে ৯টা বাজবে ঘড়িতে। এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ঘড়ির কাঁটাকে বারোর ঘরে যেতে দেখলো। বং শব্দটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সে পেন্ডুলামটা হাত দিয়ে ধরে ফেললো।
ঘড়ির ভেতরের মেকানিজমগুলো শোনা যাচ্ছে। কনর হাত বাড়িয়ে মিনিট আর সেকেন্ডের কাটা-দুটো বারো থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কাঁটাগুলো নড়তে না চাইলেও সে আরও জোর দিয়ে কাঁটাগুলোকে ঘোরাচ্ছে। একটা ক্লিক শব্দ হলো। ঘোরানো এখন শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বং শব্দটাও এখন যেন অদ্ভুতভাবে হচ্ছে, আর বারবার ক্লিক শোনা যাচ্ছে।
কনর বুঝতে পারলো তার কপালে ঘাম জমে গেছে।
-একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো, সেই দুঃস্বপ্ন যেখানে পুরো জগত হারিয়ে যায়, কিন্তু যেই দুঃস্বপ্নে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেখানে সে নিজেই একটা দুঃস্বপ্ন-