এই ঘরটা একটা পুরনো জাদুঘরের মতো! কোনো টেলিভিশনও নেই। একটা রান্নাঘর আছে যেটার বাতি হয়তো কখনোই জ্বালানো হয় না।
কনর বসে বসে বই পড়তে লাগলো, আর কীই-বা করার আছে?
বাবা এসে পৌঁছানোর আগে তার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তার নতুন স্ত্রীর অত্যাবশ্যকীয় মাইগ্রেনের ব্যথার কারণে তা কখনো সম্ভব হয় না। সামনাসামনি কথা বলতে হয় ।
কনর পেন্ডুলামের ঘড়ির দিকে তাকালো। ১২টা বেজে ৪২ মিনিট। আর তিন মিনিট পর পেন্ডুলামটা বেজে উঠবে।
তিনটি নিস্তব্ধ মিনিট।
কনর বুঝতে পারল সে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। অনেক দিন হয়ে গেছে সে তার বাবাকে স্কাইপ ছাড়া দেখেনি। সে কি দেখতে অন্যরকম হয়ে গেছে? কনর কি দেখতে অন্যরকম হয়ে গেছে?
এবং সাথে আরও একটি প্রশ্ন আছে। সে এখনই কেন আসছে? তার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, হাসপাতালে যাওয়ার পাঁচ দিন পরেও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। কিন্তু এখনও আশা আছে। ক্রিসমাস তো আরও অনেক মাস পরে আর কনরের জন্মদিন তো চলেই গেছে। তাহলে বাবা এখন কেন আসছে?
কনর মেঝের দিকে তাকালো যার মাঝামাঝি খুবই দামী একটা কার্পেট। সেটা উঠিয়ে নিচে দেখলো মেঝের পালিশ করা বোর্ডের মাঝে খানিকটা উঁচু হয়ে আছে।
‘তুমি কি এখানে আছো?’ কনর ফিসফিস করে বললো।
ডোরবেলটা বাজতেই সে চমকে উঠে দ্রুত বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে
খুব উত্তেজিত অনুভব করছে, তাড়াতাড়ি সামনের দরজা খুললো।
তার বাবা এসেছে, দেখতে পুরোপুরি অন্যরকম। কিন্তু সেই বাবাই।
‘এই, বাবা!’ তার বাবা বললো। কণ্ঠে আমেরিকান একটা টান আছে।
এক বছরের মধ্যে এই প্রথম কনর এভাবে হাসলো।
চ্যাম্প
‘সবকিছু কেমন চলছে, চ্যাম্প?’ পিজ্জা আসার অপেক্ষা করতে করতে বাবা জিজ্ঞেস করলো।
‘চ্যাম্প?’ কনর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো।
‘সরি’ বাবা কাচুমাচু হয়ে বললো, ‘আমেরিকাতে ভাষা পুরোপুরি অন্যরকম।’
‘তোমার কণ্ঠ খুবই হাস্যকর শোনাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।’
কনর তার কোকে চুমুক দিলো। আজ হাসপাতালে তার মায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। শেষমেশ নানু মাকে টয়লেটে নিয়ে গেল। মা এতটাই ক্লান্ত ছিল যে কেবল কনরকে ‘সোনামণি’ আর বাবাকে ‘হ্যালো লিয়াম’ বলে ডাকতে পেরেছিল। এর পরেই মা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তখন নানু রাগী একটা চেহারা নিয়ে তাদেরকে চলে যেতে বলে। সেই চেহারা দেখে বাবাও তর্ক করতে চাইছিল না।
‘তোমার মা, তোমার মা আসলে একটা যোদ্ধা, তাই না?’
বাবা বললো।
‘তো তুমি সবকিছু কীভাবে নিচ্ছ, কনর?’
‘আসার পর থেকে প্রায় ৮০০ বার এই প্রশ্নটা করেছো আমাকে।’
‘সরি’
‘আমি ঠিক আছি। মাকে নতুন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তাতে করে মা ভালো হয়ে যাবে। তাকে দেখতে খুবই রোগা দেখাচ্ছে, কিন্তু এমন তো আগেও হয়েছিল। সবাই এবার এমন করছে-?
‘তুমি ঠিক বলেছো বাবা।’ বাবা বললো, ‘তুমি একদম ঠিক বলেছো।’ সে তার ওয়াইন-গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো, ‘তবু, তোমাকে আরও সাহসী হতে হবে, অনেক বেশি সাহসী হতে হবে, তোমার মায়ের জন্য।’
‘তুমি আমেরিকান টেলিভিশনের মতো কথা বলছো।’
বাবা হাসলো, ‘তোমার বোন খুব ভালো আছে, এখন হাঁটতে শিখেছে।’
‘সৎ বোন।’ কনর তাকে শুধরে দিলো।
‘তোমার সাথে কবে যে তার দেখা করাবো। তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ক্রিসমাস হলে কেমন হয়?’
কনর তার বাবার চোখের দিকে তাকালো, ‘তাহলে মা কোথায় থাকবে?’
‘তোমার নানুর সাথে কথা বলে নিয়েছি। সে বলেছে বুদ্ধিটা খারাপ না, স্কুলের নতুন টার্ম শুরু হওয়ার আগেই তুমি ফিরে আসতে পারবে।’
কনর টেবিলের কোনায় হাত বুলালো, ‘তার মানে, শুধু দেখা করবো?
‘মানে?’ বাবা একটু অবাক হয়ে বললো, ‘দেখা করা মানে হচ্ছে–’ কনর বুঝতে পারছে বাবা কী বলতে চাচ্ছে। ‘কনর–’
কিন্তু কনর তাকে কথাটা শেষ করতে দিলো না, ‘একটা গাছ আমার সাথে দেখা করতে আসে।’ কোকের বোতলের লেবেলটা খুলতে খুলতে হুট করে কথাটা বলে ফেললো সে, ‘রাতের বেলা বাসায় আসে, এসে আমাকে গল্প শোনায় । ‘
বাবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, ‘কী?’
‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা একটা স্বপ্ন।’ কনর লেবেলটা তার আঙুল দিয়ে খোঁচাতে শুরু করে, ‘কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার ঘরের মেঝেতে ছোটো ছোটো গাছ উঠছে। আমি সেগুলো লুকিয়ে রাখি।’
‘কনর—’
‘সেটা এখনও নানুর বাসায় আসেনি। মনে হয় তার জন্য নানুর বাসাটা খুব দূরে–’
‘তুমি কি
‘কিন্তু তাতে কী আসে যায়। এটা তো কেবল একটা স্বপ্ন, তাই না? স্বপ্ন শহরের এক কোণ থেকে আরেক কোনায় কীভাবে যাবে? যদিও সেটা খুব বিশাল—’
‘কনর থামো—’
‘আমি নানুর বাসায় থাকতে চাই না।’ আচমকাই কনরের কণ্ঠ শক্ত হয়ে গেল। সে একদৃষ্টে কোকের বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে, ‘আমি তোমার সাথে কেন থাকতে পারি না? আমেরিকাতে তুমি যেখানে থাকো। ‘
বাবা তার ঠোঁট চাটলো, ‘মানে যখন–’
‘নানুর বাসাটা একটা বয়স্ক মহিলার বাসা।’ কনর বললো।
বাবা ছোট্ট করে হাসলো, ‘তুমি তাকে বয়স্ক মহিলা বলেছো–এটা তো আমি অবশ্যই বলবো তাকে।
‘কোথাও বসা যায় না, কোনো কিছু ছোঁয়াও যায় না।’ কনর বলতে থাকলো, ‘দুই সেকেন্ডের জন্য কোথাও ময়লা রাখা যায় না, আর তার অফিস ছাড়া অন্য কোথাও ইন্টারনেট নেই।’