‘তুমি নিশ্চিত?’
‘আমি নিশ্চিত।’
‘কারণ,’ একটু থেমে নিচের দিকে তাকালো, ‘কারণ এখন তুমি আমাকে বলতে পারো।’
মা তাকে জড়িয়ে ধরলো, তার শরীরটা খুবই নরম। কিছু না বলে কেবল কনরকে জড়িয়ে ধরে রাখলো সে। দুজনে মিলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
‘এটা একটা গাছ, তুমি জানো তো?’ মা বললো।
‘তুমি আমাকে কম হলেও একশোবার বলেছো এটা।’
‘আমি না থাকালে ভুমি একে দেখে রেখো, ঠিক আছে? আমি ফিরে আসতে আসতে যেন এটা এখানেই থাকে।’
কনরের মধ্যে বিশ্বাস জাগলো–মা এভাবে বলছে, সুতরাং সে ফেরত আসবে, আসতেই হবে। দুজন একসাথে বাইরে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
তারা যতই তাকিয়ে থাকুক না কেন, সেটা একটা গাছ হয়েই রইলো।
নানুর বাসা
পাঁচ দিন হয়ে গেছে, দানবটা আসছে না ।
হয়তো সেটা নানুর বাসা চেনে না, অথবা এখানে আসতে পারছে না। নানুর বাসা তাদের বাসার চেয়ে বড়ো, কিন্তু ওখানকার মতো কোনো বড়ো বাগান এখানে নেই। নানু তার বাগানের জায়গায় বিশাল এক অফিস রুম বানিয়ে নিয়েছে, যেখানে সে বেশিরভাগ সময়ে নিজের অফিসের কাজ করে। কী যেন এস্টেট এজেন্টের কাজ, যেটার কথা কনর কখনও শোনেনি। এখানে সবকিছুই ইটের তৈরি, আর যত্রতত্র ফুলের পট রাখা। বড়ো গাছ রাখার কোনো জায়গায় নেই, ঘাসও নেই।
‘ওখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন, ছেলে?’ নানু একটা কানের দুল পরতে পরতে বললো, ‘তোমার বাবা তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসবে। আমি তোমার মাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছি।’
‘আমি হাঁ করে দাঁড়াইনি।’ কনর বললো।
‘যাই হোক, ভেতরে এসো।’
নানু দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে গেল এবং আস্তে আস্তে কনর তাকে অনুসরণ করলো। আজ রবিবার, তার বাবা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসবে। এখানে এসে কনরের সাথে কিছুক্ষণ থাকবে। এরপর তারা মাকে দেখতে যাবে।
বাবা আসার সময়টাতে নানু থাকবে না, এটা হয়তো সবার জন্যই ভালো।
‘সামনের হলো থেকে তোমার ব্যাগটা নিয়ে এসো প্লিজ।’ নানু তার হ্যান্ডব্যাগ নিতে নিতে বললো, ‘তোমার বাবা যেন এসে না ভাবে তোমাকে খামারে রেখে দেওয়া হয়েছে।’
‘তেমনটা হবার সুযোগই নেই।’ কনর ফিসফিসিয়ে বলে। নানু আয়নায় লিপস্টিক চেক করছে।
মায়ের হসপিটালের রুম থেকে নানুর বাসাটা বেশি পরিষ্কার। বুয়া মার্টা বুধবারে আসে, কিন্তু সে আসার কোনো কারণ কনর বুঝতে পারে না। নানু একদম সকালে ঘুম থেকে ওঠে। নিজেই নিজের লন্ড্রি করে নেয়, আর রাতে ঘুমানোর আগে বাথরুম পরিষ্কার করে রাখে। খাবারের সাথে সাথেই থালাগুলো পরিষ্কার করে ফেলে। একবার তো কনরের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই প্লেট নিয়ে ডিশওয়াশারে রেখে দিয়েছিল মহিলা।
‘আমার বয়সী এক মহিলা যে কি না একা থাকে’ নানু দিনে কমপক্ষে একবার বলে, ‘আমিই যদি সবকিছু ঠিকমতো না রাখি, তাহলে কে রাখবে?’
সে যেন চ্যালেঞ্জের সুরে কথাটা বলে।
প্রতিদিন সকালে নানু তাকে স্কুলে দিয়ে আসে, কেবল পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা। আর স্কুল শেষ হওয়ার পরে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বাইরে। তারা এরপর হাসপাতালে মাকে দেখতে যায়। সেখানে এক ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে নানুর বাসায় চলে আসে তারা। কোনো কোনো দিন মা বেশি ক্লান্ত থাকলে ওরা আগেই ফিরে আসে। নানু তাকে আদেশ দিয়ে দিয়ে হোমওয়ার্ক করায়, আর বাইরে থেকে আনা খাবার খাওয়ায়।
অনেকটা কর্নওয়ালে কনর আর মা এক গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়ে যখন একই বিছানায় সব কাজ সারতে হয়েছিল, সে দিনগুলোর মতো। পার্থক্য হলো–এবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হচ্ছে।
‘আর’ নানু সুট পড়তে পড়তে বললো, ‘তোমার বাবা হয়তো খেয়াল করবে না যে তোমার মা দিন দিন কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, ঠিক আছে? সুতরাং তাকে বেশি দিন এখানে রাখা যাবে না।’ আজ রবিবার, কিন্তু তাও নানু হাসপাতালে যাওয়ারর জন্য সুট পরে বের হচ্ছে, হয়তো বাবাকে অপ্রীতিকর বোধ করানোর জন্যে এমনটা করছে।
‘এমন না যে সে থাকলে কোনো সমস্যা হবে আমাদের।’ নানু এবার ঘুরে তাকে বিদায় জানালো, ‘ভালো ছেলে হয়ে থেকো।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এখন কনর বাসায় একা।
কনর যে গেস্টরুমে ঘুমায়, সেখানে চলে গেল। নানু এটাকে কনরের নিজের রুম বলে, কিন্তু কনর কখনও এটাকে গেস্টরুম ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু নানু তাকে পইপই করে বলে এটাকে যেন সে কখনও গেস্টরুম না বলে ।
মহিলা কী চায়? এটা তো তার ঘরের মতো দেখতে না। এটা দেখতে কারো ঘরের মতোই না। সবগুলো দেয়াল খালি, কেবল তিনটা জাহাজের ছবি ঝুলানো, হয়তো নানু ভেবেছে ছেলেদের ঘর এ-রকমই হয়। এমন তিন পাশে ফ্যাকাশে সাদা রং কখনোই একটা ছেলের ঘরের না। পুরো ঘরটায় সাদা রং, বিছানার চাদরগুলোও সাদা, ফার্নিচার বলতে কেবল একটা ওক ক্যাবিনেট।
হয়তো এটা কারো ঘর হতে পারত, কিন্তু কনরের পছন্দ না। পারলে তো সে নানুর বাসা থেকে চলে যায়। ব্যাগটা রেখে বের হতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
কেবল পাথরের রাস্তা আর অফিসঘর।
আর কিছুই তার দিকে তাকিয়ে নেই।
বসার ঘরটা এমন একটা ঘর যেখানে আসলে কেউই বসতে যায় না। কনর সেখানে সব সময় যেতে পারে না। তাই এখন সে ওখানে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মেঝেটা কাঠের তৈরি, সোফার অপর পাশে একটা ক্যাবিনেট যার ওপর কিছু চায়ের কাপের সেট আর নানুর পছন্দের ঘড়িটা রাখা, যেগুলো কেউ ভুলেও ধরতে পারে না। এসব নানু তার নিজের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। ঘড়িটার নিচে একটা পেন্ডুলাম ঝুলছে। প্রতি পনেরো মিনিট পরপর সেটা বেজে ওঠে।