কনর দাঁড়ালো, কিন্তু তার দিকে তাকালো না।
‘আমি কিন্তু অন্ধ না এবং আমি জানি হ্যারি কেমন। সে যতই চটপটে হোক না কেন, তার স্বভাবের কথা আমি জানি।’
কনর কিছু বললো না। তাদের মাঝে কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা চলে এলো, যার সাথে কনর খুব ভালোভাবেই পরিচিত। মিস ওয়ানের অঙ্গভঙ্গি দেখে সে বুঝতে পারছে যে এখন সে কী বলবে; আর সেটা বুঝতে পেরেই কনর বিরক্ত হয়ে উঠলো।
‘আমি বুঝতে পারছি তোমার ওপর দিয়ে এখন কী যাচ্ছে, কনর।’ মিস ওয়ান ধীরে ধীরে বললো, ‘কিন্তু তুমি যদি কখনো কথা বলতে চাও আমার সাথে, বলতে পারো।’
কনর তার দিকে তাকাতে পারছে না, তার সামনে থাকতেও কাছে অসহ্য লাগছে।
কারণ এটা তার প্রাপ্য নয়।
দুঃস্বপ্নটা তার চোখের সামনে চলে এলো, সেই আতঙ্ক আর তীব্র চিৎকার, আর শেষমেশ যা হয়েছিল
‘আমি ঠিক আছি মিস, আমার ওপর দিয়ে কিছুই যাচ্ছে না।’
‘ঠিক আছে। এখন ভেতরে চলো।’ মিস তাকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
এক মুহূর্তের জন্য সে যেন পুরোপুরি একা বোধ করতে লাগলো। সে জানে সে যদি এখানে সারাদিন একা দাঁড়িয়ে থাকে, তারপরও তাকে কেউ কোনো শাস্তি দেবে না, যেটা তার কাছে শাস্তির চেয়েও কম কিছু না।
কথোপকথন
স্কুলের পর নানুকে সোফায় বসে তার জন্যে অপেক্ষা করতে দেখলো কনর।
‘কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’ দরজা বন্ধ হতে না হতেই নানু বলে উঠলো। চেহারার অভিব্যক্তিটা একটু অন্যরকম। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল কনর।
‘কী হয়েছে?’
নানু বড়োসড়ো একটা নিঃশ্বাস নিলো। যেন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বাজপাখির মতো দেখাচ্ছে তাকে।
‘তোমার মাকে আবার হাসপাতালে চলে যেতে হবে।’ নানু বললো, ‘তোমাকে কয়েকদিন আমার সাথে থাকতে হবে, ব্যাগ গুছিয়ে নাও।’
কনর নড়লো না, ‘কী হয়েছে তার?’
নানু এমনভাবে চমকে উঠলো যেন এমন বোকা একটা প্রশ্ন সে আশা করেনি, ‘তার খুব কষ্ট হচ্ছে, অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যথা হচ্ছে।’
‘সে-সবের জন্য তো ওষুধ দেওয়া আছে–’ কনর বলতে শুরু করলো, কিন্তু নানু তাকে থামিয়ে দিলো।
‘সে-সব কাজ করছে না, কনর।’ নানু তার দিকে না তাকিয়েই বিষণ্ন ভাবে বললো, ‘সে-সব কাজ করছে না।’
‘কোন সব কাজ করছে না?’
নানু যেন দুহাত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
‘তোমার মা ওপরে, তোমার সাথে তার কিছু কথা বলার আছে।’
‘কিন্তু–’
‘তোমার বাবা রবিবারে আসবে।
সোজা হয়ে দাঁড়ালো কনর, ‘বাবা আসবে?’
‘আমাকে কিছু ফোন করতে হবে।’ নানু উঠে দাঁড়িয়ে তার মোবাইল নিয়ে বাইরে চলে গেল।
‘বাবা কেন আসছে?’ পেছন থেকে কনর জিজ্ঞেস করলো।
তোমার মা অপেক্ষা করছে।’ বলে নানু দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
কনর তার ব্যাগটা এখনও নামানোর সুযোগ পায়নি!
বাবা আসছে। তার বাবা আসছে, আমেরিকা থেকে। যে কি না গত ক্রিসমাসের আগের ক্রিসমাস থেকে এখানে আসে না, যার স্ত্রী একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে কোনো না কোনো অসুখে পড়ে যায় বলে সে আর আসতে পারে না। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে তো আরও সুযোগ হয় না। সেই বাবা যাকে কনর বড়ো হওয়ার সময় পাশে পায়নি, কেবল ফোনকলই পেয়েছে।
তার বাবা আসছে।
কেন?
‘কনর?’ মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল।
সে তার ঘরে নেই, সে এখন কনরের ঘরের বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের চার্চ আর পাহাড় দেখছে।
এবং সেই ইয়ো গাছটা।
কেবলই একটা ইয়ো গাছ।
‘সোনামণি!’ কনরকে দেখে হাসলো, কিন্তু তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তার কষ্ট হচ্ছে। এমনটা কেবল আর একবারই দেখেছে কনর, যখন মা হাসপাতালে গিয়ে রাতের বেলা আর ফিরতে পারেনি। তখন ইস্টারের সময় ছিল, আর নানুর বাসায় থাকাটা যেন অসহ্য হয়ে উঠেছিল কনরের জন্যে।
‘কী হয়েছে? তুমি আবার হাসপাতালে যাচ্ছ কেন?’ জিজ্ঞেস করলো কনর।
মা ইশারায় তাকে নিজের পাশে এসে বসতে বললো। তার মাথায় এখন লাল গোলাপের স্কার্ফটা বাঁধা, কিন্তু সেটার নিচে মাথার চামড়াটা দেখা যাচ্ছে। নানুর আনা পরচুলা পরার কথা মনে হয় সে ভেবেও দেখেনি।
‘আমি ঠিক হয়ে যাবো।’ মা বললো, ‘সত্যিই ঠিক হয়ে যাবো।
‘তাই কি?’
‘এসব তো আগেও হয়েছে। ভয় পেয়ো না। আমি আগেও অসুস্থ হয়েছি এবং ঠিকও হয়ে গিয়েছি। এবারও তা-ই হবে। এসে মায়ের কাছে বসবে না?’
কনর কাছে গেল। মায়ের হাসিটা যেন অমলিন। যেন সত্যিকারের হাসি। সে মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তার চোখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিলো, আর ঠিক তখনই কনর লক্ষ করলো তার মায়ের হাত কত চিকন, কেবল হাড্ডি আর চামড়া।
‘বাবা কেন আসছে?’
মা থেমে গেল। ‘অনেকদিন হয়ে গেছে সে আসে না, তাই না? তুমি খুশি হওনি?’
‘নানু খুশি হয়নি মনে হচ্ছে।’
‘তুমি তো জানোই সে তোমার বাবার ব্যাপারে কেমন বোধ করে। সে-সব নিয়ে ভেবো না। তুমি তোমার বাবার সাথে মজা কোরো।’
দুজন খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো, ‘আরও কিছু আছে, তাই না?’ কনর জিজ্ঞেস করলো।
মা সোজা হয়ে বসে বললো, ‘আমার দিকে তাকাও, বাবা।’
কনর যদিও চাচ্ছিল না, তবুও ঘুরে তার দিকে তাকালো।
‘সম্প্রতি চিকিৎসাগুলো ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে না। এগুলোতে যদি কাজ না হয়, তাহলে অন্য কিছু চেষ্টা করতে হবে।’
‘এটুকুই?’
‘এটুকুই। আরও অনেক কিছু করা যেতে পারে, ভয় পেয়ো না।’