কনর কিছু না বলে কেবল হাঁটতে থাকলো।
‘তুমি কি পালটা কিছু বলবে না?’
‘না।’
‘কেন না?’
‘কারণ আমি এসবের জন্য দুঃখিত নই।’
‘কনর–’
‘আমি দুঃখিত নই এবং আমি তোমাকে মাফ করবো না।’
কনর আর লিলি একে অপরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
‘আমার মা বলেছে তোমাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে হবে, তোমাদের চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’
এক মুহূর্তের জন্য সূর্যটা মেঘের পেছনে ঢাকা পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য কনর কেবল বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে পেল, যেন আকাশ থেকে বাজ তার হাতের ওপর এসে পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন লিলিকে সে মেরে ফেলবে
‘কনর?’ একটু চমকে উঠে বললো লিলি।
কনর খুব দ্রুত তাকে রেখে চলে গেল ।
মাত্র এক বছর আগে লিলি তার বন্ধুদেরকে কনরের মায়ের খবরটা জানিয়েছিল। সে-সব বন্ধু তাদের বন্ধুদেরকে বলেছে, এবং তারা তাদের বন্ধুদেরকে বলেছে। এভাবে কনরের আশপাশের সবাই জেনে গেছে। ব্যাপারটা এমন যেন কনর এমন এক বৃত্তের কেন্দ্রে আছে যার ভেতরে সবাই আসতে ভয় পায়। কনর যখন আসে, তখন হুট করেই যেন সবাই চুপ হয়ে যায়। যদিও লিলি ছাড়া এমন কোনো বন্ধু তার নেই, কিন্তু তারপরও সে তার আশপাশে অনেক ফিসফিসানি শুনতে পায়। এমনকি শিক্ষকেরাও তাকে দেখে অন্যরকমভাবে তাকাতে শুরু করলো।
ধীরে ধীরে বন্ধু-বান্ধবের মাঝে যাওয়া বন্ধ করে দিলো, ফিসফিসানি শুনে ও তাকানো বন্ধ করে দিলো।
কেউ হয়তো খেয়াল করেনি, কিন্তু সে ধীরে ধীরে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
গত বছরের মতো স্কুলের এমন কষ্টের বছর তার আর কখনও যায়নি। তার মায়ের চিকিৎসা চলছিল, যেটা খুবই কষ্টকর ছিল তাদের জন্য। নতুন বছর শুরু হবার সময় তারা ভেবেছিল–এখন নতুন কিছু শুরু হবে, আগের সবকিছু পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে যাবে।
কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। তার মায়ের চিকিৎসাগুলো যেন আরও দীর্ঘতর হতে লাগল। নতুন বছরের শিক্ষকেরা যেন তাকে কেবল তার মায়ের ব্যাপারটার জন্যই চিনতে পারে, আর অন্য ছেলেমেয়েরা তার সাথে এমন আচরণ করে যেন সে নিজেই অসুস্থ; হ্যারি আর তার চেলারা তো এখন তার পিছু ছাড়ে না।
এখন বাসায় তার নানু চলে এসেছে, আর সে স্বপ্নে গাছ দেখে বেড়াচ্ছে।
অথবা এটা কোনো স্বপ্নই না, যেটা আরও খারাপ ব্যাপার।
রেগেমেগে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগলো সে। এসবের বেশিরভাগই লিলির দোষ, তাই না?
সে সময়ই হ্যারির ঘুসিটা তার পেটে লাগলো।
আঘাতে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় কংক্রিটে লেগে তার হাঁটু ছিলে গেল। সাথে সাথে তার ইউনিফর্মও কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। এটাই সবচেয়ে বাজে ব্যাপার এখন–সে সেলাই জানে না।
‘তুমি এভাবে চলো কেন ও’ম্যালি, প্রতিদিনই পড়ে যাও।’ সালি হাসতে হাসতে বললো।
‘তোমার হয়তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।’ এন্টনের কণ্ঠও শোনা গেল।
‘মনে হয় ও মাতাল।’ সালি হাসতে হাসতে বললো। তবে কনর বুঝতে পারল যে হ্যারি হাসছে না। ঘাড় না ঘুরিয়েই সে বুঝতে পারলো হ্যারি কেবল তার দিকে তাকিয়ে আছে, হাসছে না; ভাবছে–কনর এখন কী করবে।
উঠে দাঁড়াতেই কনর দেখলো, লিলি কিছু মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে; কথা বলছে না, কেবল দাঁড়িয়ে আছে। কনরের দিকে চোখ পড়তেই সে ভেতরে চলে গেল।
‘আজ তোমার কুকুরটা তোমাকে সাহায্য করতে এলো না।’ সালি হাসতে হাসতে বললো।
‘তোমার কপাল ভালো, সালি।’ হ্যারি এই প্রথমবারের মতো কথা বললো। কনর এবারও ঘুরে দাঁড়ালো না, কিন্তু বুঝতে পারলো যে সালির কৌতুকে হ্যারি হাসছে না। লিলির চলে যাওয়া পর্যন্ত কনর সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
‘এই, আমরা যখন কথা বলছি, তখন আমাদের দিকে তাকাবে তুমি।’ এ কথা বলতে বলতেই সালি রেগেমেগে কনরের কাঁধে হাত রাখলো।
‘ওকে ছোঁবে না, ও’ম্যালি এবং আমার মাঝে একটা বোঝাপড়া আছে, কেবল আমি তাকে ধরতে পারবো, ঠিক আছে?’ হ্যারি বলে উঠলো।
কনর একটু চুপ থেকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো। তাদের মাঝে আসলেই
কোনো বোঝাপড়া হয়ে গেছে যেন।
হ্যারি নির্লিপ্তভাবে কনরের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার কাছাকাছি এসে পড়লো। এমনভাবে তাকালো যেন সে কোনো প্রশ্ন করবে, কিন্তু কীভাবে করবে তা বুঝতে পারছে না। কনর নড়লো না। বাকি সবাই ভেতরে চলে গেছে। এখন তাদেরকেও যেতে হবে।
কিন্তু কেউই নড়ছে না ।
হ্যারি তার মুঠি এমনভাবে তুলে ধরলো যেন এখনই কনরকে ঘুসি মারবে; কনর প্রস্তুত ছিল।
কিন্তু ঘুসিটা এলো না।
‘হ্যাঁ, আমি এমনটাই ভাবছিলাম।’ হ্যারি তার মুঠি নামাতে নামাতে বললো । ‘এই ছেলেরা!’ মিস ওয়ান রেগেমেগে সবাইকে ডেকে বললো, ‘ব্রেক তিন মিনিট আগেই শেষ হয়ে গেছে। তোমরা এখনও এখানে কী করছো?’
‘সরি মিস।’ হ্যারি হঠাৎ করে খুশি হয়ে বললো, ‘আমরা মিস মার্লের জীবনগাথার হোমওয়ার্ক নিয়ে কথা বলছিলাম।’ সে কনরের কাঁধে এমনভাবে হাত রাখলো যেন তারা বন্ধু, ‘কনরের মতো গল্প আর কেউ বলতে পারে না, আর এই গল্প নিয়ে কথা বলতে সে খুব পছন্দও করে।’
‘হ্যাঁ।’ মিস ওয়ান বললো, ‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখানে কোনো সমস্যা হলে তোমরা সবাই শাস্তি পাবে বলে দিলাম।’
‘জি, মিস।’ অ্যান্টন আর সালি হ্যারির পেছন পেছন ভেতরে চলে গেল, তাদের কিছুটা পেছনে কনর।
‘একটু এদিকে এসো, কনর!’ মিস ওয়ান বললো ।