তাহলে আপনি বা আমি জীবিত লোকদের বিচার করব কেন?
০২. জনগণের সঙ্গে ব্যবহারের রহস্য
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
জনগণের সঙ্গে ব্যবহারের রহস্য
এই পৃথিবীতে অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর একটাই মাত্র উপায় আছে। কোনদিন কথাটা সম্পর্কে কখনও ভাবতে চেয়েছেন? হ্যাঁ, পথ বলতে একটাই আছে তা হলো অন্য সেই লোকটিকে কাজে আগ্রহী করে ভোলা।
মনে রাখবেন এ ছাড়া আর অন্য কোন পথ নেই।
অবশ্য কোন মানুষের পাঁজরায় রিভলবার চেপে ধরে তার ঘড়িটা আপনাকে দিতে বাধ্য করতে পারেন। কোন কর্মচারিকে কাজ করতেও বাধ্য করতে পারেন-অবশ্য আপনি পিছন না ফেরা : পর্যন্ত–আর সে বাধ্যতা আনতে পারবেন তাকে কর্মচ্যুত করার ভয় দেখিয়ে। কোন বাচ্চাকে কাজ করাতে পারেন তাকে চাবুক মারার ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোন ভয় দেখিয়ে। কিন্তু এই ধরণের নিষ্ঠুর পদ্ধতির ফলশ্রুতিতে মেলে অবাঞ্ছিত কিছু।
আপনাকে দিয়ে ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারি শুধু আপনি যা চান তাই আপনাকে দিয়ে। কিন্তু আপনি কি চান?
ভিয়েনার বিখ্যাত ড. সিগমুণ্ড ফ্রয়েড, যিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতনামা একজন মনোবিজ্ঞানী। তিনি একবার বলেন যে আপনি বা আমি যা কিছু করি সেটার উৎপত্তি দুটো উদ্দেশ্য থেকে : যৌন আবেগ আর বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক প্রফেসর জন ডিউক এটাকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ডঃ ডিউক বলেন, মানব মনে গভীরভাবে যে আকাঙক্ষা প্রোথিত থাকে তা হলো, বিখ্যাত হওয়ার বাসনা। কথাটা ভালো করে মনে রাখবেন। বিখ্যাত হওয়ার বাসনা এটা খুবই তাৎপর্যময়। এ বিষয়ে এ বইটিতে আরও অনেকবার এটার মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে।
আপনি কি চান? হয়তো তেমন বেশি কিছু নয়, তবে যে সব অল্প কিছু জিনিস আপনি চান সেগুলো যাতে আপনাকে দিতে অস্বীকার করা না হয় তার জন্য নিশ্চয়ই দাবী জানাবেন আপনি। প্রায় প্রত্যেক স্বাভাবিক প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষই এইগুলি আশা করে
১। স্বাস্থ্য ও জীবন রক্ষা। ২। খাদ্য। ৩। ঘুম। ৪। টাকা পয়সা এবং টাকায় কেনা যায় সেরকম জিনিসপত্র। ৫। পরের জীবন। ৬। যৌন আনন্দ ও তৃপ্তি। ৭। সন্তানের সুখ সুবিধা। ৮। নিজের প্রাধান্যবোধ।
এসবের প্রায় সবগুলোই পাওয়া সম্ভব–শুধু একটি ছাড়া। কিন্তু খাদ্য বা ঘুমের মত গভীর আকাঙক্ষা বা জরুরী জিনিসেরই মত আরও একটি জিনিস আছে। এটাকেই ফ্রয়েড বলেছিলেন বড় হওয়ার আকাঙক্ষা, একেই আবার ডিউক ও বলেছেন বিখ্যাত হওয়ার বাসনা।
লিঙ্কন একবার একটা চিঠি শুরু করেন এই ভাবে : প্রত্যেকই প্রশংসা পছন্দ করে। উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন : ‘মানব চরিত্রের গভীর এক আকাঙক্ষা হলো প্রশংসা পাওয়ার আকৃতি। লক্ষ্য করবেন তিনি ইচ্ছা’ বা ‘আশা’ বা ‘বাসনা’ কথাটা ব্যবহার করেন নি। তিনি ব্যবহার করেছেন ‘আকুতি’ কথাটা।
এখানেই দেখা যাচ্ছে মানুষের অদ্ভুত, নির্ভুল এক ক্ষুধা। এখানেই বিরল প্রকৃতির সেই মানুষ, যিনি হৃদয়ের এই ক্ষুধা মিটিয়ে দিতে পারেন তার পক্ষেই সমস্ত মানুষকে তার হাতের মুঠোয় রাখা সম্ভব। আর এটাও ধ্রুব সত্য, যে লোকটি কবর দিয়ে তার জীবিকা নির্বাহ করে সেও এমন মানুষের মৃত্যুতে দুঃখবোধ করে।
মানুষ আর জানোয়ারের মধ্যে অন্যতম প্রধান তফাৎ হলো তার বিখ্যাত হওয়ার মনোবাসনা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক : আমি যখন মিসৌরীতে খামারে কাজ করতাম আমার বাবা ডুরক-জার্সি জাতের চমৎকার শুয়োর আর সাদা-মুখ গরু পালন করতেন। গ্রামের মেলায় আমরা ওই সব শুয়োর আর সাদামুখ গরু প্রদর্শন করতাম। আমরা এতে বহুবার প্রথম পুরস্কারও পাই। আমার বাবা সাদা সিল্কের কাপড়ে পুরস্কারগুলো ওই সব নীল ফিতেগুলো ভালো করে এঁটে রাখতেন আর যখন বন্ধুরা বা কোন দর্শক আসতেন বাবা কাপড়ের এক প্রান্ত আর আমি অন্যপ্রান্ত ধরে সকলকে দেখাতাম।
শুয়োগুলো অবশ্য যে নীল ফিতে তারা জিততো তাই নিয়ে মাথা ঘামাতো না। তবে বাবা ঘামাতেন। পুরস্কারগুলো বাবার মনে একটা শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগাতে চাইতো।
আমাদের পূর্বপুরুষদের যদি এ ধরনের জ্বলন্ত শ্রেষ্ঠত্ববোধের আকাঙক্ষা না থাকতো তাহলে সভ্যতা গড়ে ওঠাই অসম্ভব হতো। এটা না থাকলে আমরাও হতাম ওই সব জন্তু জানোয়ারের মত।
এই রকম শ্রেষ্ঠত্ব বোধের তাগিদেই এক অশিক্ষিত, দারিদ্র-পীড়িত মুদীর দোকানের কোরানী কোন বাড়ির বাড়তি কিছু পিপের মধ্যে পাওয়া কিছু আইনের বই পড়তে আরম্ভ করেছিলেন। বইগুলো তিনি কিনেছিলেন মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট খরচ করে। আপনারা হয়তো এই কেরানীর কথা শুনে থাকবেন তিনি আর কেউ নন,স্বয়ং আব্রাহাম লিঙ্কন।
এই রকম শ্রেষ্ঠত্ব বোধের অনুভূতিই ডিকেন্সকে তার অমর উপন্যাসগুলো লিখতে প্রেরণা দিয়েছিলো। এই আকাঙক্ষাই স্যার ক্রিস্টোফার রেনুকে পাথরের মধ্যে দিয়ে সুর সৃষ্টির প্রেরণা জোগায়। এই আকাঙক্ষাই আবার রকফেলারকে লক্ষ লক্ষ টাকা করার সাহায্য করে কিন্তু তিনি তা খরচ করেন নি! আর এই আকাঙক্ষাই আপনার শহরের সবচেয়ে ধনী মানুষটিকে বিশাল এক প্রসাদ বানাতে ও উদ্বুদ্ধ করেছে, যে বাড়ি তার প্রয়োজনের তুলনায় ঢের বড়।
এই আকাঙক্ষাই আপনাকে সর্বাধিক পোশাক পরতে আগ্রহী করে তোলে, আগ্রহী করে একেবারে আধুনিক গাড়ি চালাতে আর আপনার চমৎকার ছেলে মেয়েদের সম্বন্ধে গল্প বলতে আগ্রহী করে।