কখনও কাউকে কোন তিরস্কার করার আগে আমাদের উচিত পকেট থেকে একটা পাঁচ ডলারের নোট বের করে লিঙ্কনের ছবিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা এমন সমস্যার সম্মুখীন হলে লিঙ্কন কি করতেন?
আপনার কি এমন কাউকে জানা আছে যাকে পরিবর্তিত করে তার উন্নতি ঘটিয়ে পরিচালিত করতে চান? চমৎকার! খুব ভালো কথা। আমিও মনে প্রাণে সেটা সমর্থন করি। তবে একাজ আপনার নিজেকে দিয়েই শুরু করছেন না কেন? এটাকে বেশ স্বার্থপরতার দৃষ্টিতেই দেখতে পারেন, এটা বরং অন্য কাউকে বদলে যাওয়ার চেষ্টার চাইতে অনেক বেশি লাভজনক–কথাটা নিছক সত্যি, আর ঢের কম বিপজ্জনকও বটে।
ব্রাউনিং একবার বলেছিলেন, কোন মানুষ যখন নিজের মধ্যেই সংগ্রাম শুরু করতে চায় তখন বুঝতে হবে তার কিছুটা মূল্য আছে। কাজটা ঠিক এখনই শুরু করলে আগামী বড়দিনের মধ্যেই হয়তো নিজেকে শুধরে নিতে পারবেন। হয়তো এর পরেই দীর্ঘ অবসরের পর নববর্ষের দিনগুলোয় অন্যান্য সব মানুষকে আপনি সমালোচনা করতে পারবেন।
তবে আগেই নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করে ঠিক করে নিন।
কনফুশিয়াস বলেছিলেন, ‘আপনার পড়শীর ছাদের অবস্থা দেখে অনুযোগ জানাবেন না যখন আপনার নিজের সদরই অপরিচ্ছন্ন।’
আমার বয়স যখন খুবই অল্প তখন মানুষকে প্রভাবিত করার বেশ চেষ্টা করতে চাইতাম। সেই সময় আমেরিকার সাহিত্যকাশে স্বমহিমায় বিরচণ করতেন যিনি, সেই রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসকে আমি একটা মূখের মত চিঠি লিখেছিলাম। আমি লেখকদের সম্বন্ধে এক সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ রচনা করছিলাম আর এই জন্যই ডেভিসকে অনুরোধ জানাই তাঁর কাজের পদ্ধতি আমায় জানাতে। এর কয়েক সপ্তাহ আগে আমি একজনের কাছ থেকে একটা চিঠি পাই, তার তলায় লেখা ছিল ‘এটা তিলিখিত, কিন্তু পঠিত হয়নি। আমার দারুণ ভালো লেগেছিল সেটা। আমার মনে হয়েছিল লেখক নিশ্চয়ই মস্ত একজন কেউ,হয়তো খুবই ব্যস্ত আর নামী। কিন্তু ব্যস্ততা আমার কণামাত্রও ছিল না, তা সত্বেও রিচার্ড ডেভিসের মধ্যে আমার সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মানোর জন্যই আমার চিঠির শেষে লিখে দিই তিলিখিত, কিন্তু পঠিত নয়।’
তিনি সে চিঠির কোন উত্তর দেননি। তিনি শুধু আমার চিঠিটার তলায় এ কথা কটি লিখে ফেরৎ দেন : ‘ভদ্রতার কণামাত্রও আপনার জানা নেই।’ কথাটা সত্যি, আমি খুব বোকামি করেছিলাম। তাঁর ওই গালাগাল আমার পাওনা ছিল। তবে আমি রক্ত মাংসের মানুষ বলেই সেটা সহ্য করতে পারিনি। আমার বিতৃষ্ণাটা এমন স্তরেই পৌঁছেছিলো যে দশ বছর পরে যখন রিচার্ড হার্ডিং ডেভিসের মৃত্যুসংবাদ পাঠ করি তখনও কথাটা আমার মনে ছিলো–অবশ্য স্বীকার করতে আমার লজ্জাই হচ্ছে–কথাটা হলো, তিনি আমাকে আঘাত দিয়েছিলেন।
ধরুন আগামীকাল আমার আপনার মধ্যে একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলো–সেটা কিন্তু কয়েক দশক ধরেই জিইয়ে থেকে মৃত্যু পর্যন্তও থাকতে পারে। সামান্য সমালোচনা করে দেখা যাক, আর সেটা যতখানি যুক্তিসঙ্গতই আমরা ভাবি না কেন।
মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করার সময় আমাদের মনে রাখা দরকার যে আমরা যুক্তিসহ কোন প্রাণীর সঙ্গে ব্যবহার করছি না। আমরা এমন কোন প্রাণীর সঙ্গে কারবার করছি যাদের রয়েছে ভাবাবেগ–এই প্রাণীরা টগবগ করছে সংস্কার নিয়ে আর তারা চালিত হয় অহঙ্কার এবং গর্ব নিয়ে। তাছাড়া সমালোচনা ভয়ঙ্কর একটা স্ফুলিঙ্গ-যে স্ফুলিঙ্গ অহমিকার কেন্দ্রবিন্দুতে বারুদের মধ্য বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে–যে বিস্ফোরণে কখনও কখনও মৃত্যুও ত্বরান্বিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেনারেল লেনার্ড উডকে সমালোচনা করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ফ্রান্সে যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে তার অহমিকায় যে আঘাত লাগে তাতেই বোধ হয় তার জীবন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল।
অত্যন্ত তিক্ত সমালোচনায় ইংরাজী সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ রত্ন টমাস হার্ডিকে চিরকালের জন্যই উপন্যাস লেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। এই সমালোচনাই আবার ইংরাজ কবি টমাস চ্যাটারটনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
.
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন যৌবনে খুবই ভোলামনের ছিলেন, অথচ তিনিই আবার পরবর্তী কালে এমন কুশলী আর জনগণের সঙ্গে ব্যবহারে এমনই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে তাঁকে ফ্রান্সে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। তাঁর সাফল্যের রহস্যটা কি? ফ্রাঙ্কলিন নিজেই বলেছিলেন :..আমি কাউকেই নিন্দা করবো না … সকলের মধ্যে যেটুকু ভালো সেটাই শুধু বলবো।
যে কোন মূখের পক্ষেই সমালোচনা, নিন্দা বা অভিযোগ জানানো সহজ কাজ–বেশিরভাগ মূর্খই তাই করে।
কিন্তু অপরকে বুঝতে পারা আর ক্ষমাশীলতা পেতে গেলে দরকার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর আত্ম সংযম।
কার্লাইল বলেছিলেন, ‘কোন মহান মানুষের মহত্বের প্রকাশ ঘটে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেন তার মধ্য দিয়ে। তাই মানুষকে নিন্দা না করে বরং তাদের বুঝতে চেষ্টা করি আসুন। চেষ্টা করে দেখা যাক তারা যা করে সেটা তারা কেন করে। এটাই সমালোচনার চেয়ে ঢের বেশি লাভজনক এবং কিছুটা বিহ্বলতাময়ও আর এর মধ্য দিয়ে আসে সহানুভূতি, ধৈর্য এবং দয়া ভাব। সবাইকে জানার অর্থই হলো সবাইকে ক্ষমা করা।’
ড. জনসন যেমন বলেছিলেন : ‘স্বয়ং ইশ্বরও মানুষের মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্ত তাকে বিচার করেন না।’