বছরের পর বছর ধরে টলষ্টয়ের স্ত্রী ঘ্যানর ঘ্যানর করে, গালাগাল দিয়ে চিৎকার করতেন যেহেতু তিনি কোন টাকা পয়সা না নিয়ে তাঁর বই স্বাধীনবাবে ছাপতে দিয়ে দেন। তাঁর স্ত্রী চাইতেন এর পরিবর্তে টাকা।
তাঁকে বাধা দিলে শ্রীমতী টলষ্টয় পাগলের মত চিৎকার করে গড়াগড়ি খেয়ে আফিঙ খেতে যান। তিনি শপথ করেন আত্মহত্যা করবেন, তাই একবার তিনি কুঁয়োয় ঝাঁপিয়েও পড়তে যান।
ওদের বিবাহিত জীবনে এমন ঘটনা আছে যেটাকে আমার মনে হয় ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখ জনক ঘটনা। আমি আগেই বলেছি ওদের বিবাহিত জীবন গভীর আনন্দময় বলেই মনে হয়েছিলো অথচ আঠচল্লিশ বছর পর টলষ্টয় তাঁর স্ত্রীকে দেখতেও রাজি ছিলেন না। একদিন সন্ধ্যায় এই ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধা, প্রেমের আর আদরের প্রয়াসী টলষ্টয়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে কাতর আবেদন জানালেন; পঞ্চাশ বছর আগে তিনি স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তার ডায়রীতে যে প্রেমের নিবেদন লিখেছিলেন সেগুলো পাঠ করে শোনাতে। তিনি যখন সেগুলো পড়তে আরম্ভ করলেন, সেই সুন্দর হারানো সুখের দিনগুলো যেন আবার ফিরে এসেছিলো। দুজনের চোখেই তখন জল। বহুঁকাল আগে যে রোমান্টিক দিন তাদের জীবনকে আনন্দের আবরণে ঘিরে রেখেছিলো সে স্বপ্ন আজ কোথায় হারিয়ে গেছে।
শেষপর্যন্ত টলস্টয় আশি বছরে পা দিতে তিনি গৃহকোণের আনন্দহীন জীবন আর সহ্য করতে পারলেন। তাই তুষারপাতে আচ্ছান্ন ১৯১০ সালের অক্টোবরের এক রাতে তিনি গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। কোথায় চলেছেন না জেনেই সেই ঠাণ্ডা অন্ধকারে তিনি হারিয়ে যেতে চাইলেন।
এগারো দিন পরে একটা রেল স্টেশনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেরেন। তাঁর মৃত্যুকালীন অনুরোধ ছিলো তাঁর স্ত্রীকে যেন তার সামনে আসতে দেয়া না হয়।
কাউন্টেস টলষ্টয় তাঁর ঘ্যানর ঘ্যানর, অনুযোগ আর হিস্টিরিয়ার জন্য এই দামই দিয়েছিলেন।
পাঠক হয়তো ভাবছেন তাঁর ঘ্যানর ঘ্যানর করার যথেষ্ট কারণ ছিলো। সেটা মানছি। কিন্তু আসল কথা তা নয়। প্রশ্ন হলো : ঘ্যানর ঘ্যানরে তাঁর কি লাভ হয়? না, তাতে খারাপ অবস্থাটা আরও খারাপ করে তোলা হয়?
আমার মনে হয় আমি সত্যিই পাগল ছিলাম’ এই কথাই কাউন্টেস টলস্টয় ভাবতেন–তবে তখন ঢের দেরি হয়ে গিয়েছিল। আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনের দুঃখময় পরিচ্ছেদও একই কারণ–তাঁর বিয়ে। তাঁর হত্যাকাণ্ড নয়, তাঁর বিয়ে। বুথ যখন গুলি করে, লিঙ্কন বুঝতেই পারেন নি তাকে গুলি করা হয়েছে, কিন্তু তিনি তেইশ বছর ধরে অনুভব করেছেন তার বিবাহিত জীবনের বিষাক্ত জ্বালা। এটা কম করেই বলা হলো। প্রায় শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ ধরে মিসেস লিঙ্কন ঘ্যানর ঘ্যানর করে তাঁর জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছিলেন।
তিনি সব সময় অভিযোগ করতেন আর স্বামীকে সমালোচনা করতেন, লিঙ্কনের কোন কাজই ঠিক ছিলো না। তাঁর কাঁধ বাঁকানো। তিনি অদ্ভুতভাবে হাঁটেন, ডান পা বেশি তোলেন, অনেকটা রেড ইণ্ডিয়ানদের মত, এই ছিলো অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করতেন তার চলাফেরার কোন ছন্দ নেই, তিনি ব্যঙ্গ করে তারহটা দেখাতেন যেহেতু তিনি নিজে মাদান মেন্টেলের স্কুলে শিক্ষা পান।
কাউন্টেস টলস্টয় স্বামীর বড় বড় কাজ পছন্দ করতেন না। তিনি এও বলেছিলেন তাঁর নাকটা বড় খাড়া, ঠোঁট উঁচু, তাঁকে যক্ষারোগীর মত দেখায়। তার হাত পা বড় বড় আর মাথাটা আকারে খুব ছোট।
আব্রাহাম লিঙ্কন আর মেরী টড লিঙ্কন সব দিক থেকেই আলাদা ছিলেন। সেটা শিক্ষা দীক্ষা, অতীত, রুচি, মানসিক দৃষ্টিভঙ্গী সব কিছুতেই। তারা পরস্পর সব সময়ে বিরক্তি উৎপাদন করতেন।
সেনেটের অ্যালবার্ট জে. বেভারিজ যিনি এ যুগের সবসেরা বিশেষজ্ঞ, লিঙ্কন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : ‘মিসেস লিঙ্কনের গলার স্বর ছিলো কর্কশ। বহুদূর থেকেই সেটা শ্রুতি গোচর হত। তাঁর বাড়ির কাছাকাছি সকলেই ওদের ঝগড়ার ব্যাপার জানত। প্রায়ই মিসেস লিঙ্কনের ক্রোধের প্রকাশ ঘটতো অন্যভাবেও। আর এটা ছিল অসংখ্য।‘
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিঃ আর মিসেস লিঙ্কন তাঁদের বিয়ের পর মিসেস জ্যাকব নামের এক মহিলার বাড়িতে থেকেছেন।
এক সকালে মিঃ আর মিসেস লিঙ্কন যখন প্রাতরাশ বসেছিলেন কোন কারণে লিঙ্কনের কথায় তার স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীর মুখে গরম কফির কাপ ছুঁড়ে মারেন। এটা তিনি করেন সকলের সামনেই।
কোন কথা না বলে লিঙ্কন লজ্জিত হয়ে চুপচাপ বসে থাকেন আর গৃহকর্ত্রী একটা তোয়ালে এনে তাঁর মুখ আর পোশাক মুছে দেন।
মিসেস লিঙ্কনের ঈর্ষা এমনই মূর্খের মতো আর অবিশ্বাস্য ছিল যে এগুলো আলোচনা করলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। সকলের সামনেই তিনি এসব করতেন। তিনি অর্থাৎ মিসেস লিঙ্কন শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যান। হয়তো তিনি বরাবরই পাগল ছিলেন।
এইসব ঘ্যানর ঘ্যানর আর গালমন্দ এবং অহেতুক রাগ কি লিঙ্কনকে বদলে দেয়? এক রকম তাই। অন্তত স্ত্রীর প্রতি তার আচরণ। নিজের বিয়ে সম্বন্ধে তার মোহ কেটে যায় আর স্ত্রীকে তাই তিনি যথাসাধ্য পরিহার করে চলতেন। দুঃখের কথা যে লিঙ্কন ফিল্ডে তাকতে চাইতেন না। বছরের পর বছর এরকম চলেছিলো। বাড়ি থাকতে তার ভয় হতো। শীত আর বসন্ত কালের তিনটি করে মাস তিনি অন্য জায়গায় থাকতেন কখনও স্প্রিং ফিল্ডের ধারে কাছে যেতেন না।