নেপোলিয়ন আর তাঁর স্ত্রীর কি না ছিলো-স্বাস্থ্য, সম্পদ, ক্ষমতা, খ্যাতি, সৌন্দর্য, ভালোবাসা, প্রেম-রোমান্স ভরা জীবনে যা যা দরকার। কোন ভালোবাসায় ভরা আলোকোজ্জ্বল্প জীবন এর চেয়ে ভালো হয়ে ছুটতে পারে না।
কিন্তু হায়, সেই আলো শিগগিরই যেন নিভে এলো-পড়ে রইল এক মুঠো ছাই। নেপোলিয়ন ইউজিনকে সাম্রাজ্ঞী করেছিলেন, কিন্তু নেপোলিয়নের প্রেম বা সিংহাসন তার ঘ্যানর ঘ্যানর করা বন্ধ করতে পারেনি।
ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হয়ে আর সন্দেহের জ্বালায় ইউজিন নেপোলিয়নের কোন কথাই শোনেন নি এমন কি তাকে এক মুহূর্তও একাকী থাকতে দেন নি। শাসন কার্য চালানোর সময় রাজসভায় ঢুকেও তিনি অতি দরকারী কাজ কর্মে বাধা দিয়েছেন। তিনি তাঁকে একেবারেই একা থাকতে দিতে চাননি এই ভয়ে যে হয়ত তিনি অন্য কোন রমণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করছেন।
প্রায়ই ইউজিন তার বোনের কাছে স্বামীর নামে অভিযোগ করতেন। আর সঙ্গে কান্নাকাটি এবং ঘ্যানর ঘ্যানর করতেন, ভয় দেখাতেন। পাঠাগারে ঢুকে স্বামীকে গালাগাল দিতেন। ফ্রান্সের সম্রাটের এক ডজন প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও কোথাও তিনি শান্তি পেতেন না।
এসব করে ইউজিনের কি লাভ হয়?
উত্তরটা এই রকম : আমি ই.এ. রাইনহার্টের লেখা ‘নেপোলিয়ান ইউজিন’ নামে বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমনই দাঁড়ালো যে নোপোলিয়ন প্রায়ই রাত্রিবেলা নিজের চোখ টুপিতে ঢেকে পিছনের দরজা দিয়ে গোপনে প্রাসাদ ছেড়ে এক সুন্দরী মহিলার কাছে যেতেন। মহিলাটি তাঁকে ভালবাসতেন। পাথরের রাস্তায় একলা হেঁটে বেড়াতেন সম্রাট। রূপ কথাতেই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। সম্রাট খালি ভাবতেন,আহা আমার জীবন যদি সত্যিই এমন হতো।’
ঘ্যানর ঘ্যানর করার ফলে ইউজিনের জীবনে এই রকমই ঘটে যায়। সত্যি তিনি ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন। এটাও সত্যি পৃথিবীতে সে সময় সবসেরা সুন্দরী ছিলেন তিনিই। তা সত্ত্বেও কিন্তু ঘ্যানর ঘ্যানরের বিষাক্ত কামড় তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি। প্রাচীন কালে জনের মত ইউজিনও তাই বিলাপ করতে পারতেন : যা ভয় করেছিলাম আমার জীবনেই তাই ঘটেছে। তার জীবনে এটা এসেছে? মোটেই না, বেচারি মহিলাটি ঈর্ষা আর ঘ্যানর ঘ্যানর করে নিজেই তা এনেছেন।
নরকের শয়তান প্রেম ভালোবাসা ধ্বংস করার জন্য যত রকম উপায় উদ্ভাবন করেছে ঘ্যানর ঘ্যানর তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। এ কখনও ব্যর্থ হয় না। গোখরো সাপের বিষের মত এটা সব নষ্ট করে শেষ করে দেয়।
কাউন্ট লিও টলষ্টয়ের স্ত্রীরও সেটা আবিষ্কার করেন তবে বড় দেরিতে। মৃত্যুর আগে তিনি তার মেয়েদের কাছে স্বীকার করেন : ‘তোদের বাবার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। তার মেয়েরা জবাব দেয়নি। তারা সবাই কাঁদছিলো। তারা জানতো তাদের মা ঠিক কথাই বলছেন। ওরা জানতো সারা জীবন ধরে শুধু অভিযোগ করে, সমালোচনা করে আর শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর করেই তিনি স্বামীর মৃত্যুর কারণ হন।’
অথচ কাউন্ট লিও টলষ্টয় আর তাঁর স্ত্রী নানা অসুবিধা সত্ত্বেও সুখী হতে পারতেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক তাঁর অমর সৃষ্টি ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পীস‘ এবং ‘আনা কারেনিনা’ চিরকাল ধরেই পৃথিবীর সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
টলস্টয় এতই বিখ্যাত ছিলেন যে তাঁর স্তাবকরা দিনরাত ছায়ার মতই তাঁকে অনুসরণ করতো আর তিনি যা বলতেন সবাই তাঁরা সর্টহ্যাণ্ডে লিখে রাখতো। তিনি যদি বলতেন, মনে হচ্ছে এবার শুতে যাব’ তাহলে এই সাধারণ কথাও তারা লিখে রাখতো। এখন রুশ সরকার তিনি সারা জীবনে যা যা লিখেছেন সবই প্রকাশ করতে চলেছেন, হয়তো তার সব লেখার সংখ্যা দাঁড়াবে একশটা বই।
খ্যাতি ছাড়াও টলষ্টয় আর তার স্ত্রীর ছিলো সম্পদ, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, ছেলে মেয়ে। কোন বিবাহ এত সুন্দর হয় না। গোড়ায় মনে হত তাদের বিবাহিত জীবন বুঝি খুবই আনন্দের হবে। তারা তাই হাঁটু গেড়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাত যেন এমন সুখ চিরকাল থাকে।
তারপরেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। টলষ্টয় আস্তে আস্তে বদলে গেলেন। তিনি হয়ে পড়লেন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। যে সব বিখ্যাত বই তিনি লিখেছিলেন সেগুলোর জন্য তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন আর তখন থেকে সারা জীবন উৎসর্গ করলেন শান্তি প্রচার আর যুদ্ধ ও দারিদ্র বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রচার পত্র লেখা শুরু করেন।
যে মানুষ যৌবনে একবার স্বীকার করেন সমস্ত রকম অপরাধই তিনি করেছেন–এমন কি খুনও তিনিই আবার যীশুর শিক্ষা অনুসরণ করতে আরম্ভ করেন। তিনি নিজের সব জমি দান করে দিয়ে দরিদ্রের জীবন বেছে নেন। তিনি নিজের জুতো নিজেই বানাতেন, মাঠে কাজ করতেন, খড় কাটতেন। নিজেই নিজের ঘর ঝাঁট দিয়ে কাঠের পাত্রে খেতেন আর শত্রুদের ভালো করার চেষ্টা করতেন।
লিও টলষ্টয়ের জীবন একটা বিয়োগান্ত অধ্যায় আর এর জন্য দায়ী ছিলো তার বিয়ে। তাঁর স্ত্রী বিলাসিতা পছন্দ করতেন কিন্তু টলষ্টয় সেটা ঘৃণা করতেন। তাঁর স্ত্রী চাইতেন খ্যাতি আর সামাজিক প্রতিষ্ঠা, কিন্তু এসব সামান্য জিনিস তিনি চাইতেন না, এর কোন দাম তার কাছে ছিলো না। তার স্ত্রী চাইতেন টাকা পয়সা আর সম্পদ, আর তিনি ভাবতেন ধনদৌলত এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখা পাপ।