.
তা সত্ত্বেও, কোন কারণে যদি কাউকে সমালোচনা করতে হতো তিনি ছিলেন নিশ্চয় লিঙ্কনই। একটা উদাহরণ দেখা যেতে পারে :
গেটিসবার্গের যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিনে। ৪ঠা জুলাই রাতে শত্রু সেনাপতি লী দক্ষিণে পশ্চাদপসরণ করতে আরম্ভ করলে সারা দেশ মেঘে ঢাকা পড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়, ফলে। লী যখন পটোম্যাক নদীর কাছে তার পরাজিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাজির হন তিনি সভয়ে দেখতে পান তার সামনে ফুলে ফেঁপে ওঠা ভয়ঙ্কর এক নদী, যেটা পার হওয়া অসম্ভব, আর তার পিছনে তাড়া করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় বিজয় বাহিনী। ফাঁদে পড়েছিলেন লী, তার পালানোর আর পথ ছিল না। ব্যাপারটা লিঙ্কন বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর হাতে এসেছিল ঈশ্বর-প্রেরিত এক সুবর্ণ সুযোগ-লী’র সেনাবাহিনীকে অবরুদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করার সুযোগ। অতএব দারুণ আশায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিঙ্কন কোন সামরিক পরামর্শ সভা না ডেকে সঙ্গে সঙ্গে লীকে আক্রমণ করতে সেনাপতি মীডকে আদেশ করলেন। লিঙ্কন টেলিগ্রাফ করে লীকে আদেশ জানানোর পর বিশেষ এক দূত পাঠিয়েও মীডকে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে বললেন।
কিন্তু জেনারেল মীড কি করলেন? তাকে যা করার আদেশ দেওয়া হয় তিনি ঠিক তার উল্টোটাই করলেন। লিঙ্কনের হুকুম তিনি সরাসরি অগ্রাহ্য করে সামরিক পরামর্শ সভা ডাকলেন। তিনি ইতস্ততঃ আর দীর্ঘ সূত্রতা অবলম্বন করে লিঙ্কনকে টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে নানরকম ওজর আপত্তি তুললেন। তিনি সরাসরি লীকে আক্রমণ করতে অস্বীকৃত বলে জানালেন। শেষ পর্যন্ত নদীর জল কমে গেলে লী তার সেনাবাহিনীসহ পটোম্যাক নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হলেন।
ক্ষেপে আগুন হয়ে গেলেন লিঙ্কন। এসবের উদ্দেশ্য কি? লিঙ্কন চিৎকার করে তাঁর ছেলে রবার্টকে বলে উঠলেন। হা ঈশ্বর! এসবের মানে কি? শত্রুকে আমরা আমাদের হাতের মুঠোতে পেয়েছিলাম, শুধু হাত বাড়ালেই ওরা আমাদের হতো। তা সত্ত্বেও আমার কথায় বা আদেশে আমার সেনাবাহিনী একটুও নড়লো না। এমন অবস্থায় যে কোন সেনাপতিই লীকে পরাজিত করতে পারতো। ওখানে আমি থাকলে আমি লী-কে নিজেই চাবকাতে পারতাম।
তিক্ত হতাশায় লিঙ্কন ভেঙে পড়ে তৎক্ষণাৎ নিচের চিঠিটি লিখেছিলেন : একটা কথা মনে রাখবেন তাঁর জীবনের এসময়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল আর তাঁর বাগবিন্যাসেও যথেষ্ট সতর্কতা ছিল। অতএব ১৮৬৩ সালে লিঙ্কনের কাছ থেকে আসা চিঠিটার মধ্যে আসলে ছিল তীব্র তিরস্কার।
প্রিয় জেনারেল,
আমার বিশ্বাস হয় না আপনি লী-র পলায়নের মধ্যে যে বিরাট ব্যাপার এবং দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে আদৌ সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। সে সহজেই আমাদের মুঠোর মধ্যে এসে গিয়েছিল, তাই তাঁর বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, আমাদের ইদানীং কালের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের সমাপ্তিই ঘটতে পারতো। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল ধরেই চলবে। আপনি যদি গত সোমবার নিরাপদে লীকে আক্রমণ না করে থাকতে পারেন তাহলে কিভাবে আপনি তাঁকে নদীর দক্ষিণ দিকে মোকাবিলা করবেন–বিশেষ করে সঙ্গে যখন বেশি সৈন্য নিতে পারবেন না? সেই সেনার সংখ্যা তখনকার তুলনায় দুই তৃতীয়াংশও যখন হতে পারে না! আপনার কাছে এ সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য কিছু আশা করাই অন্যায় হবে আর আমি আশাও করি না আপনি বিশেষ কিছু করতে পারবেন। আপনার সুবর্ণ সুযোগ আপনি হারিয়েছেন আর এজন্য আমি আশাতীত রকম দুঃখ লাভ করেছি।
মীড যখন এ চিঠি পেলেন তখন সেটা পড়ে তিনি কি করেছিলেন বলে আপনাদের মনে হয়?
মীড চিঠিটা আদৌ দেখেন নি। কারণ লিঙ্কন আদৌ তা তাকে দেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর লিঙ্কনের কাগজপত্রের মধ্যে চিঠিটা পাওয়া যায়।
আমার ধারণা হলো–যদিও নিছক একটা ধারণা–যে চিঠিটা লেখার পর লিঙ্কন জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে ধরে স্বগতোক্তি করেছিলেন, এক মিনিট অপেক্ষা করা যাক। মনে হয় আমার এতোটা তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। আমার পক্ষে হোয়াইট হাউসের শান্ত পরিবেশে বসে মীডকে আক্রমণ করতে হুকুম। দেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু আমি যদি গেটিসবার্গে থাকতাম আর মীড গত সপ্তাহে যে রক্তপাত দেখেছে তা দেখতাম, আহত আর মৃতকল্পদের কাতর আর্তনাদ যদি আমার কানে প্রবেশ করতো তাহলে হয়তো আক্রমণ করতে আমিও তেমন উৎসাহবোধ করতাম না। আমার যদি মীডের মত ভীরুতা মাখা মনোবৃত্তি হতো তাহলে সে যা করেছে হয়তো আমিও তাই করতাম। যাইহোক অনুশোচনা করে লাভ নেই। আমি যদি এ চিঠি ওকে পাঠাই তাতে আমি মানসিক শান্তি পাবো বটে কিন্তু পরিবর্তে মীড যেভাবে হোক আত্মসমর্পণ করে নিজেকে সঠিক বলে প্রমাণ করতে চাইবে। এটা হলে সে আমাকে দোষারোপ করতে চাইবে। এর ফলে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে তার সেনাপতি হিসেবে তার সব যোগ্যতা আর প্রয়োজনও নষ্ট হয়ে যাবে আর খুব সম্ভব এটার জন্য তাকে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগে বাধ্য হতে হবে।
অতএব আমি যা আগেই বলেছি, লিঙ্কন চিঠিটা সরিয়ে রেখে দেন কারণ তিনি বুঝছিলেন তীব্র সমালোচনা আর নিন্দা নিঃসন্দেহে ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়। থিয়োডোর রুজভেল্ট বলেছিলেন যে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন কোন গভীর সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনি আরাম কেদারায় শরীর ছড়িয়ে হোয়াইট হাউসে তার ডেস্কের পিছনে টাঙানো লিঙ্কনের বিশাল ছবিটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতেন ‘আমার মত অবস্থায় পড়লে লিঙ্কন কি করতেন?’ তিনি নিজের সমস্যার সমাধান কি ভাবেই বা করতেন?