এই হলো ব্যাপার, মানব চরিত্রের কাজই এই, দোষীরা সবসময়ই নিজেকে ছাড়া সকলকেই দোষারোপ করে চলে। আমরা সকলেই এই রকম। অতএব আপনি বা আমি যখন আজ বা কাল অন্য কাউকে সমালোচনা করার জন্য উৎসাহিত হবো তখন আমাদের মনে রাখা দরকার অল ক্যাপোন, ‘দু বন্দুকবাজ’ ক্রোলি আর অ্যালবার্ট ফলকে। আমাদের অনুভব করতে হবে সমালোচনা অনেকটা পোষা পায়রার মতই। এটা সবসময়েই নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। আমাদের আরও উপলব্ধি করতে হবে যে লোককে আমরা ঠিক পথে আনতে চাইছি বা দোষ দিতে চাইছি সে সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থণ করতে আর উল্টে আমাদেরই দোষারোপ করবে। তাছাড়াও হয়তো বা সেই শান্ত ট্যাফটের মতই বলবে, আমি বুঝতে পারিছ না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।
.
১৮৬৫ সালের ১৫ই এপ্রিলের এক শনিবারের সকালে আব্রাহাম লিঙ্কন সস্তাদরের এক সরাইখানার হলঘরের শয়নগৃহে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। সে ঘর ছিল ফোর্ডের নাট্যশালার ঠিক সামনের রাস্তায়, যে নাট্যশালায় রুথ তাকে গুলি করে। লিঙ্কনের দীর্ঘ দেহ অতি ছোট একখানা শয্যায় আড়াআড়ি অবস্থায় শায়িত ছিল। বিছানার ঠিক মাথার দিকে টাঙানো ছিল অত্যন্ত সস্তা রোসা বনহিউর বিখ্যাত ছবি ‘দি হর্স ফেয়ারের’ প্রতিলিপি আর ঘরের মধ্যে হলদে আলো ছড়িয়ে চলে ছিল একটা বিষণ্ণ গ্যাসের আলো।
মৃত্যু পথযাত্রী লিঙ্কনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘ওই যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।‘
.
জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে লিঙ্কনের সাফল্যের রহস্য কি? আমি দশ বছর ধরে আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী পাঠ করেছি আর তারই সঙ্গে তিন বছর ব্যয় করেছি অজানা লিঙ্কন’ নামে একখানা বই সংশোধন করে লিখতে। আমার বিশ্বাস কোনো মানুষের পক্ষে যা সম্ভব সেই ভাবেই আমি লিঙ্কনের ব্যক্তিত্ব এবং পারিবারিক জীবন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছি; বিশেষ করে আমি জানার চেষ্টা করেছি লিঙ্কনের জনসংযোগের পদ্ধতিকে। তিনি কি সমালোচনায় বিশ্বাসী ছিলেন? হ্যাঁ, তাই। ইণ্ডিয়ানার পিজিয়ন ক্রীক উপত্যকায় তরুণ বয়সে তিনি যে শুধু সমালোচনাই করতেন তা নয় বরং মানুষকে ব্যঙ্গ করার মধ্য দিয়ে তিনি চিঠি আর কবিতা লিখতেন। চিঠিপত্রগুলো তিনি আবার গ্রাম্য পথের বুকে ছড়িয়ে দিতেন যাতে সেগুলো অবধারিত ভাবেই পথিকের নজরে পড়ে। এই সব চিঠির মধ্যে একটার জন্য প্রচণ্ড আপত্তি ওঠে আর সেটা সারা জীবনই উত্তপ্ত জ্বালার সৃষ্টি করেছিল।
এছাড়াও লিঙ্কন ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ডে একজন ব্যবহারজীবী হিসেবে কাজ শুরু করার পরেও তিনি তার বিরোধীদের খোলাখুলি ভাবেই আক্রমণ করে খবরের কাগজে চিঠি প্রকাশ করতেন। একাজে একবার তিনি অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলেন।
১৮৪২ সালের শরঙ্কালে তিনি জেমস শিল্ডস নামে এক গর্বিত অথচ কলহপ্রিয় আইরিশ রাজনীতিককে ব্যঙ্গ করেন। লিঙ্কন স্প্রিংফিল্ড জার্নালে এক বেনামা চিঠিতে ওই লোকটিকে ঠাট্টা করে কিছু লেখেন। সারা শহরই তাতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। স্পর্শকাতর আর গর্বিত শীল্ডস এতে প্রায় ক্রোধে ফেটে পড়েন। তিনি খুঁজে বের করেন চিঠির লেখককে, তারপর তাঁর ঘোড়ায় চড়ে লিঙ্কনের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। লিঙ্কনকে পেয়েই তিনি তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন। লিঙ্কন অবশ্য লড়াই করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন–কিন্তু এ ব্যাপার থেকে তার বেরিয়ে আসার কোন সম্ভাবনাই ছিল না কারণ তাঁকে সম্মান বাঁচাতে হতো। তাঁকে অস্ত্র বেছে নিতে সুযোগ দেওয়া হলো। যেহেতু তার বেশ বড় বড় লম্বা হাত ছিল তিনি অশ্বারোহীর উপযুক্ত চওড়া তরোয়ালই বেছে নিলেন। তারপর ওয়েস্ট পয়েন্টের একজন স্নাতকের কাছে তরোয়ার খেলা শিখতে আরম্ভ করলেন। লড়াইয়ের দিনে লিঙ্কন আর শীল্ডস মিসিসিপি নদীর তীরে বালুকাবেলায় আমৃত্যু লড়াইয়ের জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রায় দুজনেরই বন্ধুরা এসে লড়াই বন্ধ করার ব্যবস্থা করলো।
লিঙ্কনের জীবনে এটাই বলতে গেলে সবচেয়ে জঘন্য এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এটাই তার কাছে মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক অমূল্য শিক্ষা। তিনি আর কখনই অপমানজনক চিঠি লেখেন নি বা আর কখনও কাউকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপও করেন নি। তারপর থেকেই প্রায় কোনদিন কাউকে তিনি সমালোচনাও করেন নি কোন কারণে।
গৃহযুদ্ধ চলার দিনগুলোর লিঙ্কন অটোম্যাকের যুদ্ধে একের পর এক সেনাবাহিনীতে নতুন নতুন সেনাপতি নিয়োগ করেন। সেই সব সেনাপতিদের মধ্যে একের পর এক আসেন ম্যাকক্লেলান, পোপ, বার্ণসাইড, হুঁকার। মীড–আর তাদের প্রত্যেকেই লজ্জাজকভাবে ব্যর্থ হওয়ায় লিঙ্কন হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়েন। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ঐ সব অপদার্থ সেনাধ্যক্ষদের ক্রমাগত দোষারোপ করে চললেও লিঙ্কনের কিন্তু কারও প্রতি কোন বিমোগার ছিল না, বরং ছিল প্রত্যেকের প্রতি সহৃদয়তা। তিনি শান্তভাবেই সব মেনে নিয়েছিলেন। তার অতি প্রিয় উক্তি ছিল কারও সমালোচনা করো না, তাহলে নিজেও সমালোচিত হবে না।
মিসেস লিঙ্কন আর অন্যান্যরা যখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের কড়া সমালোচনা করতে চাইতেন, লিঙ্কন জবাব দেন : ‘ওদের সমালোচনা কোরো না, ওই অবস্থায় পড়লে আমরাও ওই রকমই করতাম।‘