ওয়ানামেকার এ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন বেশ আগে ভাগেই, কিন্তু আমার বেলায় তা হয়নি। প্রায় শতাব্দীর এক তৃতীয়াংশ হাতড়ে বেড়াবার আগে আমার উপলব্ধি হয়নি যে শতকরা নব্বই জন মানুষই নিজের দোষ দেখেও কখনও আত্ম-সমালোচনা করতে চায় না।
সমলোচনা করা বৃথা, কারণ এতে মানুষ সাবধানী হয়ে পড়ে আর স্বভাবতই সে নিজের কাজ সমর্থন করার পথ খোঁজে। সমালোচনা মারাত্মক জিনিস যেহেতু এটা মানুষের অহমিকাকে আঘাত করে, তার আত্মগর্বে চিড় ধরে আর তার ফলে সে সেটা ঘৃণার চোখে দেখা শুরু করে।
জার্মান সেনাবাহিনীতে কোন সৈনিককে কোন ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই কোন রকম অভিযোগ পেশ করতে বা সমালোচনা করতে দেওয়া হয় না। প্রথমে তার ক্রোধ প্রশমিত করে মাথা ঠাণ্ডা করতে বলা হয়। সে যদি সঙ্গে সঙ্গে কোন অভিযোগ আনে তাহলে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। ঈশ্বর জানেন, সাধারণ মানুষের জীবনেও এরকম কিছু লাইন থাকলে ভালো হতো–যেমন হাতশাগ্রস্ত বাবা মা, ঘ্যানর ঘ্যানর করা বউ বা পরের ছিদ্র খুঁজে ফেরা জঘন্য সব মানুষের জন্য।
ইতিহাসের হাজার হাজার পাতায় এরকম সমালোচনার অসারতার উদাহরণ খুঁজে পাবেন আপনারা। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় থিয়োডোর রুজভেল্ট আর প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের বিখ্যাত সেই ঝগড়া-যে ঝগড়ার ফলে রিপাবলিকান দল প্রায় ভেঙে যায় আর উড্রো উইলসন হোয়াইট হাউসে ঢোকার সুযোগ পেয়ে যান। এর ফলে বিশ্বযুদ্ধে তিনি আলোকোজ্জ্বল লেখার সৃষ্টি করে ইতিহাসের ধারাটাই বদলে দেন।
সব ব্যাপার একটু খতিয়ে দেখা যাক। ১৯০৮ সালে থিয়োডোর রুজভেল্ট যখন হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন তিনি ট্যাফটকে প্রেসিডেন্ট বানালেন। এরপর তিনি আফ্রিকায় সিংহ শিকার করতে চলে যান। ফিরে এসেই তিনি ফেটে পড়লেন। তিনি ট্যাফটকে তার রক্ষনশীলতার জন্য ভর্ৎসনা করে নিজেই তৃতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নতুন দল গঠন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ঝগড়াটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠলো। এর পরেই নির্বাচন এলো, তাতে উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট আর তার রিপাবলিকান দলের দারুণ পরাজয় ঘটল-তারা মাত্র দুটো রাজ্য দখল করতে পারলেন–ভারমন্ট আর উটা। প্রাচীন দলটার এমন হার কখনও হয়নি।
.
থিয়োডোর রুজভেল্ট ট্যাফটকেই দোষ দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্যাফট কি নিজেকে দোষী মনে করেন? অবশ্যই না। অশ্রুসজল চোখে ট্যাফট বলেন : ‘আমি বুঝতে পারছি না অন্য আর কিছু আমি করতে পারতাম কি না।’
এখন দোষটা কার রুজভেল্টের না ট্যাফটের? সত্যি কথা বলতে গেলে আমি সেটা জানি না,গ্রাহ্যও করি না। যে কথাটা বোঝাতে চাই তা হলো থিয়োডোর রুজভেল্টের ওই সমালোচনাতেও ট্যাফট নিজেকে দোষী বলে ভাবেন নি। বরং এটা সজল চোখে ট্যাফটকে আত্মসমর্পণ করতে আর ভাবতে বাধ্য করেছিল যে তিনি আর কিছু করতে পারতেন কি না।
এছাড়া ধরুন, টিপট ডোম তেল কেলেঙ্কারীর কথাটাই। ব্যাপারটা মনে আছে? ব্যাপারটা বছরের পর বছর খবরের কাগজে আলোড়ন তুলেছিল। সারা দেশেই এতে প্রায় কাঁপন ধরেছিল। আজকের দিনে যারা জীবিত আছেন তাঁরা জানেন আমেরিকার জনজীবনে এর চেয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড আর কখনও ঘটেনি সেই কেলেঙ্কারীর ব্যাপারটা ছিলো এইরকম : হার্ডিংয়ের মন্ত্রীসভার ইন্টিরিয়র সেক্রেটারি অ্যালবার্ট ফলের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় এক হিল আর টিপট ডোমের সংরক্ষিত সরকারি তেল ভাণ্ডার লিজ দিতে–এই তেল ভাণ্ডার নৌ বাহিনীর ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্যই রাখা ছিল। সেক্রেটারি কি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দর ডেকেছিলেন মনে হয়? না, তিনি ওই দারুণ লাভজনক চুক্তির ব্যাপারটা তার বন্ধু এডওয়ার্ড এল ডোহেনিকে দিয়ে দেন। ডোহেনি কি করলেন? তিনি তার বন্ধু সেক্রেটারি ফলকে ‘ধার’ হিসেবে দিয়েছিলেন প্রায় লাখ খানেক ডলার। তারপর সেক্রেটারির ফল প্রায় স্বৈরতান্ত্রিক পথে যুক্তরাষ্ট্রীয় নৌবহরকে ওই এলাকায় গিয়ে প্রতিযোগী ব্যবসায়ীদের ‘এক হিল’ রিজার্ভে তাদের তৈল রূপ স্তূপ ব্যবহার করা নিবৃত্ত করে হটিয়ে দেবার আদেশ দেন। প্রতিযোগিরা বন্দুক আর বেয়োনেটের মুখে হটে গিয়ে বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হলেন–আর তার ফলেই টিপট ডোমের দশ কোটি ডলারের কেলেঙ্কারী ফাস হয়ে গেল। এর ফলে যে দুর্গন্ধ বেরিয়ে এলো সেটা এতই পচন ধরা যে হার্ডিং শাসন ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে গেলো। তাছাড়াও এরই সঙ্গে সারা দেশটা ঘৃণায় শিউরে উঠলো, রিপাবলিকান দলও এসে দাঁড়ালো ভাঙনের মুখে আর অ্যালবার্ট বি. ফলের জায়গা হলো কারাগারে। . ফলকে সকলেই প্রচণ্ডভাবে দোষারোপ করলোজনজীবনে এধরনের অভিযুক্ত কেউ হয়নি। কিন্তু তাতে তিনি কি অনুশোচনা করেছিলেন? কখনও না! বেশ কয়েক বছর পরে হার্বার্ট হুভার এক জনসমাবেশে বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হার্ডিংয়ের মৃত্যুর কারণ ছিল মানসিক বিপর্যয় আর দুর্ভাবনা। কারণ এক বন্ধু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মিসেস ফল যখন কথাটা শুনেছিলেন তিনি চেয়ার চেড়ে লাফিয়ে উঠে সজল চোখে নিজের ভাগ্যকেই ধিক্কার জানিয়ে চিৎকার করে ওঠেন : কি! হার্ডিংকে ফল বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? কখনও না। আমার স্বামী কোনদিন কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। এই বাড়িটা সম্পূর্ণ সোনায় মুড়ে দিলেও আমার স্বামী লোভে পড়বেন না। তারই সঙ্গে আসলে বিশ্বাসঘাতকাত করা হয়েছে আর যুপকাষ্ঠে তাকেই যীশুখ্রীষ্টের মত ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে।