দু’শ বছর আগে ধনী ব্যক্তিরা তাদের নামে বই উৎসর্গ করার জন্য লেখকদের টাকা দিতেন।
পাঠাগার আর যাদুঘরগুলোয় যে দামী সব সংগ্রহ রয়েছে তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয় মানুষকেই। বিশ্বের বহু পাঠাগারেই অনেকে বই দান করে নাম কিনতে আর তা রক্ষা করতে চেয়েছেন। নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরী বা মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে এরকম সংগ্রহ আছে। তাছাড়া প্রতিটি গির্জার জানালার কাঁচেও বহু দাতা মানুষের নাম খোদাই করা থাকে।
বহু লোক নাম মনে রাখতে পারছেন না এই সকল কারণেই যে তারা তাদের শোনা নামগুলো কষ্ট করে মনের পর্দায় চিরকালীন করে গেঁথে রাখার চেষ্টা করেন না। ওজর হল তাঁরা বড় ব্যস্ত মানুষ।
কিন্তু যত ব্যস্তই তাঁরা হোন নিশ্চয়ই ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের মত ব্যস্ত নন। রুজভেল্ট বেশ সময় ব্যয় করেই এমন কি কোন মেকানিকের সংস্পর্শে এলে তারও নাম মনে মনে রাখতেন।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ক্রাইসলার প্রতিষ্ঠান একবার মিঃ রুজভেল্টের জন্য বিশেষ ধরনের একখানা গাড়ি তৈরি করে। সে গাড়ি পৌঁছে দিতে ডব্লিউ. এফ. চেম্বারলেনের আর এক মেকানিক হোয়াইট হাউসে আসেন। আমার সামনেই রয়েছে মিঃ চেম্বারলেনের লেখা একখানা চিঠি–তিনি এটায় তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লেখেন : ‘আমি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে গাড়িটা চালানো সম্বন্ধে সব বুঝিয়ে দিতে থাকি, কিন্তু তিনি আমাকে শিখিয়ে দেন মানুষকে কেমন করে চালাতে হয়।’
‘আমি হোয়াইট হাউসে যেতেই, মি. চেম্বারলেন লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট চমৎকার খুশি হয়ে দেখা করলেন।‘ আমায় তিনি নাম ধরে ডাকলেন, আমায় বেশ সহজ হতে দিলেন। আমার আরও ভালো লাগলো এটাই দেখে যে আমি তাকে যা দেখাচ্ছিলাম সেটা তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলেন। গাড়িটা এমনভাবে বানানো হয়েছিল যে শুধু এক হাত দিয়েই চালানো যায়। গাড়িটা দেখতে বেশ লোকও জমায়েত হয়। তিনি বললেন : ‘ভারি চমৎকার গাড়ি। শুধু বোতাম টিপলেই চালানো যায়। আমার কাছে এটা দারুণ–কি করে এমন হয় জানি না, আমার এখনই চালিয়ে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে।
রুজভেল্টের বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয় স্বজন গাড়িটার প্রশংসা করতে তিনি বললেন : ‘মি. চেম্বারলেন, এটা তৈরি করার জন্য আপনারা যে সময় আর পরিশ্রম করেছেন আমি তার প্রশংসা করছি। এরপর তিনি গাড়ির সব যন্ত্রপাতি খুঁটিনাটির প্রশংসা করলেন। মিসেস রুজভেল্ট আর নিজের সেক্রেটারি মিস পার্কিনসকেও দেখালেন। তারপর পুরনো কৃষ্ণাঙ্গ চাকর জর্জকে বললেন : ‘জর্জ, তুমি সুটকেসের দায়িত্ব নেবে।’
‘শেষ পর্যন্ত চালানোর কৌশল শেখা হলে তিনি বললেন: ‘মি. চেম্বারলেন, আমি ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডকে ত্রিশ মিনিট বসিয়ে রেখেছি। এবার তাই কাজে যাই, কেমন?’
‘আমি হোয়াইট হাউসে একজন মেকানিককে নিয়ে যাই। রুজভেল্টের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্ট তাঁর সঙ্গে আগে কথা বলেন নি, শুধু নামটাই শুনেছিলেন। মেকানিক একটু লাজুক মানুষ। বিদায় নেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট মেকানিককে তার নাম ধরে ডেকে করমর্দন করে ওয়াশিংটনে আসার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। এই ধন্যবাদ দেবার মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না। সত্যিই তা ছিল আন্তরিকতা মাখা।’
‘নিউইয়র্ক ফেরার পর আমি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সই করা একটা আলোকচিত্র পাই তার সঙ্গে আমার কাজের জন ধন্যবাদও। এসব করার সময় তিনি কোথায় পেলেন এটাই আমার কাছে এক রহস্য।’
ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট জানতেন মানুষের সবচেয়ে ভালো ধারণা তৈরির সরল প্রয়োজনীয় আর গুরুত্বপূর্ণ উপায়টি হলো, মানুষের নাম মনে রাখা আর তাদের নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে দেওয়া–তবুও কজনেই বা সেটা করে?
বেশির ভাগ সময়েই কোন অচেনা মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটলে আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর যখন বিদায় নিই তার নাম আর মনে রাখি না।
কোন রাজনৈতিক নেতা প্রথমেই যা শেখেন তা হলো : ‘কোন ভোটদাতার নাম মনে রাখা বিচক্ষণ নেতার কাজ। সেটা ভুলে যাওয়া মানে নিজে ডুবে যাওয়া।’
আর এই নাম মনে রাখার দক্ষতা রাজনীতির মত ব্যবসা আর সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভাইপো ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন অহঙ্কার করে বলতেন যে, রাজকীয় কাজকর্মের ব্যস্ততা সত্ত্বেও যাদের সঙ্গে দেখা হতো তাদের নাম ভুলতেন না।
এ কাজে তার কৌশল কি রকম? খুবই সরল। নামটা পরিষ্কার না শুনতে পেলে তিনি বলতেন : ‘খুব দুঃখিত, নামটা ভালো করে শুনিনি। তারপর নামটা একটু অসাধারণ হলে তিনি বলতেন : নামের বানানটা কি রকম একটু বলবেন?’
কথাবার্তা চলার ফাঁকে তিনি বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করতেন, যাতে মনে সেটা গেঁথে রাখা যায়। সঙ্গে মনে রাখতেন লোকটির বাচনভঙ্গী, আকৃতি সব কিছু।
লোকটি নামী কেউ হলে নেপোলিয়ন আরও একটু খাটতেন। রাজামশাই একা হলেও একখণ্ড কাগজে নামটা লিখে ফেলতেন তারপর বার কয়েক চোখ বুলিয়ে মনে গেঁথে নিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলতেন। এইভাবেই তিনি লোকটির পরিপূর্ণ একটা ছবি এঁকে ফেলতেন।
এসব করতে সময় লাগে, তবে ভালো ব্যবহার করতে গেলে, এমার্সন বলেছেন, ‘ছোটখাটো স্বার্থত্যাগ করতেই হয়।’