জীবনের গোড়াতেই জিম ফাররি আবিষ্কার করেন যে সাধারণ মানুষ পৃথিবীর সমস্ত নামের চেয়ে নিজের নামকেই বেশি ভালোবাসে। ওই নাম স্মরণে রেখে সহজে সেটা বলে ডাকলেই বুঝতে হবে তাকে আপনি সবচেয়ে বেশি সম্মান দিয়েছেন। কিন্তু একবার সেটা ভুলে গেলে বা ভুল করলে, মনে রাখবেন বিরাট একটা গণ্ডগোলে পড়ে গেলেন আপনি। উদাহরণ হিসেবে জানাই যে একবার প্যারী শহরে আমি একটা বক্তৃতার ব্যবস্থা করে ওখানকার সব আমেরিকানদের নিমন্ত্রণ করি। চিঠিগুলো টাইপ করেছিল সামান্য ইংরেজী জানা ফারসী টাইপিস্টরা, স্বাভাবিকভাবেই তারা নানা গণ্ডগোল করে ফেলে। একজন, প্যারীর কোন আমেরিকান ব্যাঙ্কের ম্যানেজার তার নাম ভুল করার জন্য আমায় বেশ বকুনি দিয়েই চিঠি লেখেন।
অ্যান্ড্রু কার্নেগীর বিরাট যে সাফল্য তার কারণ জানেন?
তাকে ইস্পাতের রাজা বলা হতো, তা হলেও ইস্পাত তৈরি ব্যাপারটার তিনি প্রায় কিছুই জানতেন না। তার হয়ে কাজ করতো শয়ে শয়ে কর্মচারী–আর তারা ইস্পাত সম্বন্ধে তার চেয়ে ঢের বেশি জানতো।
কিন্তু তিনি যা জানতেন সেটা হলো মানুষকে কি করে ব্যবহার করতে হয়–আর এতেই তিনি ধনী হয়ে ওঠেন। জীবনের গোড়াতেই কোন প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আর নেতৃত্বদানে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় রাখেন। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি বুঝতে পারেন মানুষ তাদের নিজের নাম কতটা ভালোবাসে, এই আবিষ্কারটাই তিনি কাজে লাগান সহযোগিতা পেতে। একটা উদহারণ দিই : অল্প বয়সে কার্নেগী যখন স্কটল্যাণ্ডে যান তিনি একটা খরগোশ ধরেন–এটা মা খরগোশ। কিছুদিন পরেই সেটা থেকে একগাদা খরগোশ হয়ে গেলো তার–কিন্তু তাদের কি খাওয়ানো যায় কিছুই তো নেই। তখন তার মাথায় দারুণ একটা মতলব খেলে গেল। আশে পাশের ছেলেদের ডেকে তিনি বললেন, তারা যদি জঙ্গল থেকে কচি ফল আর ডালপালা আনতে পারে তাহলে বাচ্চা খরগোশের নাম তাদের নামেই রাখা হবে।
মতলবটায় ম্যাজিকের মতই কাজ হল। কার্নেগী ব্যাপারটা কোনদিন ভোলেন নি।
বহু বছর পরে তিনি একই মনস্তত্বের কৌশল কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা করেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় তার পেনসিলভেনিয়া রেল রোডের জন্য ইস্পাত বিক্রির চেষ্টা। সে সময় ওই রেলপথের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জে. এডগার টমসন। অতএব অ্যান্ড্রু কার্নেগী একটা বিরাট ইস্পাতের কারখানা গড়লেন পিটসবার্গে। তার নাম দিলেন এডগার টমসন স্টীল ওয়ার্ক।
একটা ধাঁধা দিচ্ছি। দেখুন বলতে পারেন কিনা। পেনসিলভেনিয়া রেল লাইনের জন্য যখন ইস্পাতের দরকার হল জে. এডগার টমসন কোথা থেকে তা কিনেছিলেন জানেন? … সীয়ার্স বা রোবাডের কাছে থেকে? মোটেই না, আপনার ভুল হচ্ছে। আবার ভাবুন।
.
কার্নেগি আর জর্জ পুলম্যান যখন রেল গাড়ির ঘুমের কামরার ব্যবসাতে লড়াই চালাচ্ছিলেন, ইস্পাতের রাজা তখনও সেই খরগোশের কাহিনী ভোলেন নি।
অ্যান্ড্রু কার্নেগীর সেন্ট্রাল ট্রান্সপোর্টেশান কোম্পানীর সঙ্গে পুলম্যানের কোম্পানীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। তারা দুজনেই বারবার দাম কমিয়ে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছলেন যে লাভের কোন আশা ছিল না। দুজনে নিউইয়র্কে পৌঁছলে তাঁদের হঠাৎ দেখা হলে সেন্ট নিকোলাস হোটেলে। কার্নেগী তখন বললেন ‘শুভসন্ধ্যা, মিঃ পুলম্যান, আমরা কি দুজন মস্ত বোকার মতই ব্যবহার করছি না?’
‘আপনি কি বলতে চান?’ পুলম্যান জানতে চাইলেন।
এবার কার্নেগী তার মনের কথাটা বললেন–দুটো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ একীকরণ। বেশ ফলাও করেই তিনি একসঙ্গে কাজ করার সুবিধা আর বিরুদ্ধাচারণের অসুবিধার কথাটা বুঝিয়ে বললেন। বেশ মন দিয়ে শুনে গেলেন পুলম্যান, তবে তিনি পুরোপুরি মেনে নিতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রশ্ন কররেন : ‘কোম্পানীর নাম কি হবে?’ কার্নেগী তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন : ‘কেন, অবশ্যই পুলম্যান প্যালেস কার কোম্পানী।‘
পুলম্যানের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ‘আমার ঘরে আসুন’, তিনি আহ্বান জানালেন, ‘কথা বলা যাক।‘ ওই কথাবার্তার পরিণতিতে তৈরী হয়েছিল শিল্প জগতের এক ইতিহাস।
বন্ধু বান্ধব আর ব্যবসার সহযোগিদের নাম মনে রাখা আর তাকে সম্মান জানানোর নীতিই ছিল অ্যান্ড্রু কার্নেগীর নেতৃত্ব দানের রহস্য। তাঁর গর্ব ছিল যে তিনি তাঁর বহু শ্রমিককে তাদের প্রথম নাম ধরে ডাকতে পারতেন। তিনি অহঙ্কার করেই বলতেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যতদিন দায়িত্বে ছিলেন ততদিন তাঁর সুন্দর ইস্পাত কারখানায় কখনও ধর্মঘট হয়নি।
পেডেরুস্কি আবার তার কৃষ্ণকায় পাঁচককে সব সময় ‘মি. কপার’ বলে সম্বোধন করতেন। অন্ততঃ পনেরো বার নানা অনুষ্ঠানে পেডেরুস্কি আমেরিকা ভ্রমণ করে শ্রোতাদের নানাভাবে মনোরঞ্জন করেছেন আর প্রতিবারই তিনি একটা গাড়িতে তাঁর পাঁচককে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই সে মাঝরাতে পেডেরুস্কির খাবার তৈরি করে দিয়েছে। আমেরিকানদের মত পেডেরুস্কি কখনই তার পাঁচককে ‘জর্জ’ বলে সম্বোধন করেন নি, প্রত্যেকবার ডেকেছেন ‘মিঃ কপার’ বলে আর মিঃ কপারও সেটা ভালোবাসতো।
মানুষ তার নিজের নাম নিয়ে এমনই গর্ব বোধ করে যে সেটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার চেষ্টার অন্ত নেই। অমন যে শক্ত ধাচের মানুষ পি.টি. বারনাম, তিনিও হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন যেহেতু তাঁর নাম বহন করার জন্য তাঁর কোন ছেলে ছিল না। নিজের নামকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি তার নাতি মি. এইচ সীলি’কে পঁচিশ হাজার ডলার দেন শুধু তার নামে নাম জড়িয়ে নিজেকে ‘বারনাম সীলি’ বলে প্রচার করতে।