‘একবার আমার স্ত্রী প্রেসিডেন্টকে পাখি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিল। সে কোনদিন কোয়েল পাখি দেখেনি, তাই প্রেসিডেন্ট তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেন। বেশ কিছুদিন পরে আমাদের কটেজের টেলিফোন বেজে উঠলো (অ্যামোর্স আর তার স্ত্রী অয়েস্টার বে’র রুজভেল্ট এস্টেটে বাস করতো। আমার স্ত্রী টেলিফোনে সাড়া দিতেই স্বয়ং মিঃ রুজভেল্টের গলা শুনতে পেলো। প্রেসিডেন্ট জানালেন তিনি ফোন করেছেন এটাই জানাবার জন্য যে তার জানালার সামনে একটা কোয়েল পাখি বসে আছে তিনি ইচ্ছে করলেই দেখতে পাবেন। এই রকম ছোটখাটো ব্যাপারে আগ্রহ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিশেষত্ব ছিল। যখনই তিনি আমাদের কটেজের পাশ দিয়ে যেতেন, আমরা তখন কাছাকাছি না থাকলেও তিনি ডাক ছাড়তেন, অ্যানি …জেমস্!’ যাওয়ার মুখে এটা ছিল তার বন্ধুত্বের ডাক।
এমন একজন মানুষকে কর্মচারীরা না ভালোবেসে থাকে কেমন করে? তাছাড়া তাকে ভালো না বাসার কোন কারণ ছিল না। রুজভেল্ট একবার হোয়াইট হাউসে আসেন। ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্ট ট্যাফট আর মিসেস ট্যাফট বাইরে ছিলেন। তিনি হোয়াইট হাউসের সমস্ত পরিচারকদেরই নাম ধরে ডাকলেন, এমন কি রান্নাঘরের পরিচারকাকেও। সাধারণ নিচের তলার মানুষদেরও যে তিনি কতটা ভালবাসতেন সেটা বোঝা যায় এটা থেকেই। এ বিষয়ে আর্টিবাট লিখেছেন : ‘তিনি রান্নাঘরের পরিচারিকা অ্যালিসকে দেখতে পেয়ে বললেন সে এখনও ভুট্টার রুটি বানায় কি না। অ্যালিস জানালো সে মাঝে মাঝে বানায় বটে চাকর-বাকরদের জন্য, তবে উপরতলার কেউ তা খায় না।‘
রুজভেল্ট উজ্জ্বল হয়ে বললেন : তাদের রুচিটাই বাজে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা হলে বলব।
অ্যালিস প্লেটে করে তার জন্যে একটা রুটি নিয়ে এলে সেটা চিবোতে চিবোতে তিনি অফিসের দিকে চললেন। যাওয়ার সময় সমস্ত মালী আর মজুরদের শুভেচ্ছাও জানাতে চাইলেন …।
‘তিনি অতীতে যেভাবে সবাইকে ডাকতেন সেই ভাবেই তাদের ডাকলেন। তারা নিজেরা তখনও তাঁর কথা ফিসফিস করে আলোচনা করে। আইক হুভার সজল চোখে একবার বলেছিল : দু বছরে এটাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন, আমাদের কেউই একশ ডলারের বদলেও এটা হাতচাড়া করতে চাইতাম না।‘
.
অন্যান্য মানুষের সমস্যা সম্পর্কে এত গভীর ভাবনাই ডঃ চার্লস্ এলিয়টকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট হবার মর্যাদা দিতে পেরেছে–আপনাদের হয়তো মনে আছে তিনিই গৃহযুদ্ধের শেষ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়া অবধি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলেছিলেন।
তার কাজের ধারার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একদিন কলেজে প্রথম ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্র এল, আর. জি. ক্র্যাণ্ডন প্রেসিডেন্টের অফিসে গিয়ে ছাত্রদের ঋণ ভাণ্ডার থেকে পঞ্চাশ ডলার ধার নিতে যায়। ঋণ মঞ্জুর হল। তার নিজের ভাষাতেই এবার সব শুনুন। এরপর আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে আসতে চাইছিলাম তখন প্রেসিডেন্ট এলিয়ট বললেন, দয়া করে একটু বোসো। তারপর দারুণ অবাক হলাম তিনি যেই বললেন : ‘আমি শুনলাম, তুমি নিজের ঘরে তোমার রান্না করে খাও। আমার মনে হয় কাজটা খুবই ভালো, তোমার পক্ষে, বিশেষ করে ভালো আর যথেষ্ট খাবার যদি পাও। আমি যখন কলেজে পড়তাম তাই করতাম। তুমি কখনও মাংসের রুটি বানিয়েছ? জিনিসটা বানাতে পারলে খুবই ভালো, একটুও নষ্ট হয় না। আমি কিভাবে বানাতাম এবার শোন। তিনি এরপর আমায় বুঝিয়ে দিলেন কি করে মাংস কেটে ধীরে ধীরে রান্না করতে হয় যাতে সবটা শুকিয়ে না গিয়ে বেশ শুকনো হয়, তারপর রুটির মধ্যে নিয়ে ঠাণ্ডা করে খেতে হয়।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি তাদের প্রতি আগ্রহী হলে আমিরিকার সবচেয়ে নামী লোকদের নজর, সময় আর সহযোগিতা লাভ করা সম্ভব হয়। একটা উদাহরণ রাখছি।
বেশ ক’বছর আগে আমি ব্রুকলীন ইনস্টিটিউট অব আর্টস্ অ্যাণ্ড সায়েন্সে গল্প লেখার পাঠক্রম পরিচালনা করেছিলাম। সেখানে আমরা ক্যাথলিন নরিন, ক্যালী হার্স, রিউপার্ট, হিউনেন ইত্যাদি নামী আর ব্যস্ত লেখকদের ব্রুকলীনে এনে তাদের অভিজ্ঞতার বিষয় জানাতে অনুরোধ করি। অতএব আমরা তাদের চিঠি লিখে বললাম আমরা লেখার প্রশংসা করি আর তাদের পরামর্শ পেতে আমরা খুবই আগ্রহী, আমরা আরও জানতে চাই তাদের সাফল্যের রহস্যই বা কি?
প্রতিটা চিঠিতে সই করেছিলো অন্ততঃ দেড়শ জন ছাত্রছাত্রী। আমরা লিখেছিলাম যে আমরা জানি তাঁরা অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ কোন বক্তৃতা তৈরি করা তাঁদের পক্ষে বেশ কঠিন। আর তাই আমরা সঙ্গে পাঠালাম কিছু প্রশ্ন। যেগুলোর উত্তর পেলে আমরা তাঁদের কাজের ধারা বুঝতে পারবো। তাঁদের এটা পছন্দ হলো। কার বা এমন চিঠি পছন্দ হয় না? অতএব তাঁরা তাঁদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ব্রুকলীনে এসে আমাদের সাহায্য করতে চাইলেন।
ঠিক একই রকম পদ্ধতিতে আমি জেসলি এম. শ. থিয়োডোর রুজভেল্টের অর্থ সেক্রেটারীকে, স্ট্যাফটের কেবিনেটের অ্যাটর্নী জেনারেল জর্জ ডব্লিউ উইকার্সহ্যামকে, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টাকে, আরও বহু বিখ্যাত মানুষকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে ছাত্রদের জনতার কাছে বক্তৃতার বিষয়ে বলাতে সক্ষম হই।
আমাদের সকলেই কসাই, রুটিওয়ালা বা সিংহাসনে বসা রাজা নাই হই, আমাদের যারা প্রশংসা করেন তাঁদের পছন্দ করি। জার্মানীর কাইজারের কথাটাই উদাহরণ হিসেবে ধরুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনিই বোধ হয় হড়ে পড়েন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত আর বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। এমন কি তার নিজের দেশবাসীও তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায় আর তিনিও নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে হল্যান্ডে পালিয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে তাঁকে হাতে পেলে লোকে বোধ হয় টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতো বা আগুনে গালিয়ে ফেলতো। এই রকম ক্রোধের আর ঘৃণার মধ্যে একটি ছোট্ট ছেলে কাইজারকে একখানা চিঠি লিখে তাতে তার আন্তরিকতা আর প্রশংসা জানিয়েছিল। ছোট ছেলেটি লিখেছিল অন্যরা যা বলে বলুক সে সব সময়েই উইলহেলমকে তাঁর সম্রাট হিসেবে ভালোবেসে যাবে। কাইজার চিঠিটা পেয়ে একেবারে আন্তরিকভাবে গলে যান আর ছেলেটিকে নিমন্ত্রণ করে পাঠান, সে যেন এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে। ছেলেটি এসেছিল আর সঙ্গে তার মা-ও এসেছিল–আর কাইজার পরে তাকে বিয়ে করেন। ছোট ছেলেটিকে ‘বন্ধুলাভ ও প্রভাব বিস্তার’ গোছের কোন বই পড়তে হয়নি। ব্যাপারটা সে অন্তর থেকেই উপলব্ধি করেছিল।