মনস্তত্বের উপর আপনারা প্রচুর ভালো ভালো বক্তব্য পাঠ করতে পারেন কিন্তু এর চেয়ে চমৎকার কোন বক্তব্য খুঁজে পাবেন না। এক কথা বারবার বলতে চাই না তাহলেও অ্যাডলারের বক্তব্য এতই চমৎকার সারগর্ভ যে আবার বলার লোভ সামলাতে পারছি না :
‘যে বিশেষ লোক অন্যদের সম্পর্কে আগ্রহী হতে চায় না সে দুনিয়ায় জীবন কাটাতে সবচেয়ে অসুবিধার সম্মুখীন হয় আর অন্যকেও আঘাত দেয়।‘
আমি একবার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট গল্প লেখার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। এই ক্লাস চলার সময় ‘কোলিয়ার্স’ পত্রিকার সম্পাদক আমাদের কিছু বলেছিলেন। তিনি বলেন তার টেবিলে রোজ জমা পড়া ডজন ডজন ছোট গল্পের মধ্যে থেকে একটা মাত্র তুলে নিয়ে কিছু অংশ পড়লেই তিনি বুঝতে পারেন লেখক মানুষকে ভালবাসেন কিনা। তিনি বলেন : লেখক যদি মানুষকে ভালো না বাসেন তাহলে মানুষও তার গল্প ভালো বাসবে না। ওই অভিজ্ঞ সম্পাদক ছোট গল্প নিয়ে কথা বলার সময় দুবার থেমে মার্জনা চেয়ে বলেন, তিনি একটা উপদেশ দিতে চান। তাঁর কথায় সেটা হলো এই রকম : ‘আমি আপনাদের যা বলছি আপনাদের কেউ কেউ হয়তো তাই বলবেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনারা যদি সফল গল্প লেখক হতে চান তাহলে মানুষ সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ থাকতেই হবে।‘
কল্পিত কাহিনী লেখার ক্ষেত্রে এটা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে এটা তিন গুণ বেশি সত্যি।
আমি একবার হাওয়ার্ড থানের সঙ্গে তাঁর সাজঘরে একটা সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম, ব্রডওয়েতে তিনি যেবার শেষবারের মত প্রদর্শনীতে অংশ নেন। থান ছিলেন সে কালের বিখ্যাত একজন যাদুকর। তিনি একেবারে যাদুর কিংবদন্তী ছিলেন। চল্লিশ বছর ধরে বারবার তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে মানুষকে তাঁর অলৌকিক যাদুর খেলা দেখিয়ে মুগ্ধ বিস্মিত করে তোলেন–মানুষ প্রায় বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকতো। ষাট লক্ষেরও বেশি মানুষ তাঁর যাদু প্রদর্শন দেখার জন্য টিকিট কেটে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকে আর তিনি প্রায় বিশ লক্ষ ডলার লাভ করেন।
আমি থানের কাছে তার সাফল্যের গোপন রহস্য কি জানতে চেয়েছিলাম। অবশ্য স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই–যেহেতু ছোট বেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন। নানা জীবিকাই তিনি তারপর নেন–প্রথমে হন মজুর। গাড়ির মধ্যে খড়ের গাদায় ঘুমিয়েও ছিলেন। দরজায় দরজায় ভিক্ষেও করেছিলেন বেঁচে থাকার জন্য। তাছাড়া রাস্তার সাইনবোর্ড আর বিজ্ঞাপন পড়েই তাঁর পড়াশোনায় হাতে খড়ি।
.
যাদুবিদ্যা সম্পর্কে কি তাঁর দারুণ কোন জ্ঞান ছিলো? না। তিনি নিজেই আমায় বলেছিলেন, যাদুর খেলা বা ভোজবাজী সম্বন্ধে ঢের ঢের বই আছে আর তিনি যা জানেন বহু লোকও তাই জানে। কিন্তু তার এমন দুটো জিনিস ছিল যা অন্য কারও ছিল না। প্রথমত পাদপ্রদীপের সামনে তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল। তিনি ছিলেন এক দক্ষ প্রদর্শক। মনুষ্যচরিত্র তাঁর ভালোই জানা ছিল। তিনি যাই করতেন, প্রতিটি অঙ্গভঙ্গী, কণ্ঠস্বরের বিকৃতি, সামান্য ভ্রূ তোলা–সব কিছুই খুব সতর্কতার সঙ্গে তিনি আগে থেকে অভ্যাস করে রাখতেন। তাঁর সমস্ত কাজই প্রায় সেকেণ্ডের মধ্যে করতেন তিনি, একেবারে চোখের পলকে। কিন্তু এটাই তাঁর সাফল্যের মূল আদৌ ছিল না। থান মানুষ সম্পর্কে প্রকৃতই আগ্রহী ছিলেন। তিনি আমায় বলেন যে বহু যাদুকরই দর্শকদের লক্ষ্য করে নিজেদের বলতে চায় : ‘হুম, আমার সামনে এক দল গবেট বসে রয়েছে ওদের ঠিক বোকা বানাবো।’ কিন্তু থার্স্টনের কৌশল ছিল ঠিক একেবারে আলাদা। তিনি আমায় বলেন–মঞ্চে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজেকে বলতেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ যে এতো সব মানুষ আমার খেলা দেখতে এসেছেন। এঁরাই আমার জীবনটা ভালোভাবে কাটাতে সম্ভব করে তুলেছেন। আর সেই কারণেই আমি ওঁদের আমার সব সেরা যাদুবিদ্যাই যথা সম্ভব দেখাতে চেষ্টা করব।’ তিনি এটাও বলেছিলেন, পাদপ্রদীপের তলায় তিনি কখনই নিজেকে একথা না বলে দাঁড়াতেন না : আমি আমার দর্শকদের ভালোবাসি, আমি আমার দর্শকদের ভালোবাসি। হাস্যকর বলে ভাবছেন? আপনার যেমন ইচ্ছে অবশ্য ভাবতে পারেন। আমি শুধু কথাগুলো আপনাদের কোন মন্তব্য ছাড়াই শোনাচ্ছি–যে কথাগুলো আমি শুনেছি বিশ্বের একজন সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ যাদুকরের কাছ থেকে।
মাদার শূয়্যান-হিঙ্কও ঠিক এই কথাই আমাকে বলেন। খিদে এবং ভগ্ন হৃদয়ের জ্বালা আর শোকাবহ জীবন কাটানোর ব্যর্থতার সন্তানসহ একবার আত্মঘাতী হতে গিয়েছিলেন তিনি–অথচ এমন ঘটনা সত্ত্বেও তিনি সঙ্গীত জগতের সিঁড়িতে পা রেখে ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছিলেন একেবারে তার চূড়ায়। শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে উঠেছিলেন লক্ষ লক্ষ শ্রোতার সবার প্রিয় একজন গায়িকা। আর তিনিও স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি হল, তিনি মানুষ সম্পর্কে দারুণ আগ্রহী ছিলেন।
ঠিক এই রকমই ছিল থিয়োডোর রুজভেল্টের আশ্চর্যজনক জনপ্রিয়তার রহস্যের গোড়ার কথা। এমন কি তাঁর পরিচালকরাও তাকে ভালোবাসতো। তাঁর নিগ্রো পরিচালক জেমস ই. অ্যামোর্স তার সম্পর্কে ‘থিয়োডোর রুজভেল্ট হিরো টু হিজ ভ্যালে’ নামে একখানা বই লিখেছিল। ওই বইটার অ্যামোর্স একটা ঘটনার সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন :