যে সমিতি ওই সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তারা ঠিক করলেন এই ধরণের কোন পাঠক্রম মেরিডেনের বয়স্কদের জন্য চালু করবেন। এর পর তারা বেশ পরিশ্রম করেই এই বিষয়ের কোন ব্যবহারিক পাঠ্য বইয়ের খোঁজ করেত চাইলেন–কিন্তু সে রকম কোন বই পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত তারা পৃথিবীর প্রথিতযশা কোন বয়স্ক শিক্ষণ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন ঐ উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী কোন বইয়ের কথা তার জানা আছে কি না। তিনি জবাবে জানালেন, ‘না। আমি জানি বয়স্করা কি চান। তবে যে বই তাদের দরকার তা আজও লেখা হয় নি।’
আমার অভিজ্ঞতায় আমি জানি কথাটা সত্যি, কারণ আমি নিজেই বেশ কয়েক বছর ধরে মানবিক সম্পর্কে উপর লেখা ব্যবহারিক একখানা বই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি।
যেহেতু এরকম কোন বইয়ের অস্তিত্ব ছিল না, আমার নিজের তৈরি পাঠক্রমের জন্য আমি যে বই লেখার চেষ্টা করেছি–এই সেই বই। আশা করি আপনাদের এটা ভালো লাগবে।
এ বই লিখতে গিয়ে, ওই বিষয়ের উপর লেখা যা আমার নজরে এসেছে তাই পড়েছি–এবং তা ডরোথী ডিক্সের লেখা, বিবাহ-বিচ্ছেদের বর্ণনা, ‘পেরেন্টস’ ম্যাগাজিন থেকে প্রফেসর ওভারস্ট্রীট, অ্যালফ্রেড অ্যাকলার আর উইলিয়াম জেমসের রচনা পর্যন্ত। এ ছাড়াও আমি একজন অভিজ্ঞ গবেষকের সাহায্য নিই–নানা গাঠাগারে আমি পড়তে পারিনি এমন সব বই তিনি প্রায় দেড় বছর ধরে ঘেঁটেছেন। সে সব বইয়ের মধ্যে ছিল মোটা মোটা মনোবিজ্ঞানের বই, শয়ে শয়ে সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ ইত্যাদি। অসংখ্য জীবনী ঘেঁটেও তিনি জানার চেষ্টা করেছেন যুগে যুগে মনীষীরা মানুষের সঙ্গে কিভাবে মেলামেশা করেছেন। আমরা সব যুগের মহাপুরুষদের জীবনী পাঠ করি। জুলিয়াস সীজার থেকে শুরু করে টমাস এডিসন পর্যন্ত সমস্ত বিখ্যাত নেতাদের জীবনীই আমরা পড়ে ফেলি। আমার মনে পড়ছে আমরা শুধু থিয়োডোর রুজভেল্টেরই প্রায় শ’খানের জীবনী পড়ে ছিলাম। আমরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষকে জয় করতে আর প্রভাব বিস্তার করতে যে কার্যকর ধারণা পোষণ করেছে তার প্রতিটি আবিষ্কার করার কাজে আমরা সময় আর অর্থব্যয়ে কার্পণ্য করবো না।
.
আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিই, তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিখ্যাত। তাদের মধ্যে ছিলেন মার্কনী, ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ওয়েন ডি, ইয়ং ক্লার্ক, গেবল, মেরী পিকফোর্ড, মার্টিন জনসন। এই সব খ্যাতনামাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি জানার চেষ্টা করি মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা কি কৌশল কাজে লাগিয়ে ছিলেন।
এই সব মালমশলা দিয়ে আমি ছোট্ট একটা কথিকা তৈরি করলাম। আমি এর নাম দিলাম”প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ”। এটাকে ছোট্ট বলার কারণ আছে। গোড়ায় এটা ছোট্টই ছিল। তবে বর্তমান এটা বেড়ে উঠে প্রায় দেড় ঘন্টার এক বক্তৃতাতেই পৌঁচেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে নিউইয়র্কের কার্নেগী ইনস্টিটিউটে প্রাপ্তবয়স্কদের সামনে সে বক্তৃতা আমি দিয়ে গেছি।
.
এই বক্তৃতা দিয়ে আমি তাদের অনুরোধ করেছি সেটা তাদের ব্যবসা আর সামাজিক যোগাযোগে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা করতে, তারপর আবার ফিরে এসে আমাদের জানাতে তাদের অভিজ্ঞতা আর ফললাভ কেমন হলো। সত্যিই চমৎকার একটা দায়িত্ব! এই সব স্ত্রী-পুরুষ যারা স্বভাবতই আত্মোন্নতির জন্য লালায়িত, তারা নতুন ধরনের কোন গবেষণাগারে কাজ করার প্রেরণায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। বয়স্কদের জন্য মানবিক সম্পর্কের এমন গবেষণাগার বলতে এটাই একমেবাদ্বিতীয়। এমন আর ছিল না।
এ বইটি ঠিক বই লেখা বলতে যা বোঝায় তেমনভাবে লেখা হয় নি। শিশু যেমন করে বেড়ে ওঠে সেভাবেই এটা বেড়ে ওঠে। এ বই সেই গবেষণাগারে লালিত হয়ে বেড়ে ওঠে-সে বেড়ে ওঠা হাজার হাজার বয়স্কদের অভিজ্ঞতা পুষ্ট হয়ে।
বেশ ক’বছর আগে প্রায় পোস্ট কার্ডের আকারের একখানা কাগজে আমরা কিছু নিয়ম ছাপিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করি। পরের বছর আরও বড় একখানা কার্ড ছাপালাম, তারপর একখানা পত্রিকা, তারপর এলো পরপর কতকগুলো ছোট বই। এদের প্রত্যেকটাই আকারে আর উদ্দেশ্যে প্রসারিত। আর এখন পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ফলশ্রুতিতে এসেছে এই বইটি। এ বইতে যে সব নিয়ম আমরা লিপিবদ্ধ করেছি তা শুধু তত্ত্ব বা অনুমান নয়। যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক আমি দেখেছি এই নীতি কাজে লাগিয়ে বহু মানুষের জীবনে সত্যিই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি : গত বছর এই পাঠ গ্রহণ করতে আসেন এমন একজন যার প্রতিষ্ঠানে কর্মীর সংখ্যা ৩১৪ জন। বেশ কবছর যাবৎ তিনি তাঁর কর্মীদের যথেচ্ছভাবে গালিগালাজ আর সমালোচনাই করে এসেছেন। সহৃদয় ভঙ্গি, কাজে প্রশংসা বা উৎসাহ দান তার মুখে কখনও কেউ শোনেনি। এ বইতে যে নীতির কথা আছে সেগুলো পড়ার পর ওই নিয়োগকর্তাটির জীবন দর্শন অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেল। তাঁর প্রতিষ্ঠানে আজ জন্ম নিয়েছে এক নতুন উদ্দীপনা, নতুন প্রেরণা, নতুন নিষ্ঠা আর সহযোগিতার আদর্শ। তিনশ চৌদ্দজন শত্রু তিনশ চৌদ্দজন বন্ধুতেই আজ বদলে গেছে। তিনি স্বয়ং একবার ক্লাসের সামনে বেশ গর্বভরে বলেছিলেন : আমার প্রতিষ্ঠানে যখন হেঁটে ঢুকতাম কেউ অভ্যর্থনা জানাতো না বরং আমাকে আসতে দেখে আমার কর্মচারীরা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতো। কিন্তু আজ তারা সবাই আমার বন্ধু, এমন কি আমার দারোয়ানও আমায় নাম ধরে ডাকে।’