সে কি আপনারা কি চান একবারও বলেছে? আপনারা কেউই জিমনাসিয়ামে যেতে চান না, তাই না? সে যা চায় তাও খেলতে চান না। চোখ কানা হোক তাও কেউ বোধহয় চাইবেন না।
সে কি জিমনাসিয়ামে গেলে আপনাদের কি উপকার হতো সেকথা বোঝাতে পারত? নিশ্চয়ই পারত। এতে শরীর চালনা দ্রুত হতে পারে, এতে ক্ষিদে হয়। মাথা সাফ হয়। মজা পাওয়া যায়। হৈ চৈ খেলাধুলা করা যায়, বাস্কেটবলও খেলা যায়।
প্রফেসর ওভারস্ট্রীটের কথাটা একবার শুনুন। তার কথা হল : ‘প্রথমে অন্যজনের মধ্যে একটা সাগ্রহ চাহিদা বাড়িয়ে তুলুন। যে এটা পারে সারা দুনিয়াই তার সঙ্গে থাকে। যে তা পারে না তাকে একলাই চলতে হয়।’
আমার শিক্ষানবীসদের মধ্যে একজন তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলেন। ছেলের ওজন কম ছিল, সে ঠিকমত খেতেও চাইত না। তার বাবা মা লোকে যা বলে তাই করছিলেন। ছেলেকে বকাবকি করছিলেন। ‘মা তোমাকে এটা খেতে বলেছে’ বা ‘বাবা তোমাকে মস্ত বড় হয়ে উঠতে বলেছেন।’
ছেলেটা কি ওই সব গুজবে কান দিয়েছে? একটুও না। যার মাথায় ছিটে ফোঁটা বুদ্ধিও তাকে তিনি বুঝতে পারেন, তিন বছরের একটা ছেলে আর ত্রিশ বছরের বাবার দৃষ্টিভঙ্গী এক হতে পারে না। ত। সত্ত্বেও কিন্তু এক্ষেত্রে ছেলেটির বাবা তাই চাইছিল। এটা একটা অবাস্তব ব্যাপার। অবশ্য এটা শেষ পর্যন্ত তার খেয়াল হয়। তাই তিনি নিজেকে বললেন : ‘ছেলেটা কি চায়? ও চায় আর আমি যা চাই দুটোকে মেলাবো কেমন করে?’
চিন্তা আরম্ভ করতেই ব্যাপারটা তার কাছে সহজ হয়ে গেল। তার ছেলের একটা তিন চাকার সাইকেল ছিল, সেটায় চড়ে সে তাদের ব্রুকলীনের বাড়ির পাশের রাস্তায় বেড়াতে চাইতো। কটা বাড়ির পরে রাস্তায় এক দুষ্টু ছেলে থাকতোতার ছেলের চেয়ে বয়সে সে বড়ো। সে ঐ ছোট ছেলেকে ওর সাইকেল থেকে টেনে নামিয়ে নিজেই সেটা চালাত।
স্বভাবতই ছোট্ট ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে ছুটে এসে বলতেই তার মা আবার গিয়ে সেই শয়তান ছেলেটাকে সাইকেল থেকে টেনে নামিয়ে ওকে চড়িয়ে দিতেন। এ রকমই প্রায় রোজ ঘটত।
বাচ্চাটি কি চাইত? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শার্লক হোমসের সাহায্যের দরকার হয় না। ওর অহঙ্কার, ওর রাগ, নিজেকে বড় বলে মনে করা ওর মনের এই সব আবেগই ওর মনে খেলে যেতে চাইত–আর সেটা ওকে প্রতিশোধ নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করত, সেই শয়তান ছেলেটির নাক ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে জাগত। তার বাবা এরপর যখন বাচ্চাটিকে বুঝিয়ে ছিল, সে যদি ওর মার কথামত ঠিকঠিক খেয়ে নেয় তাহলে আর কিছুদিনের মধ্যেই ও বড় হয়ে সেই শয়তান বড় ছেলেটার নাক ভেঙে একেবারে সায়েস্তা করে দিতে পারবে-ব্যাস্ এর পর তাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে আর কোন সমস্যাই রইল না। সে তখন সব খাবারই ঠিক ঠিক খেতে আরম্ভ করলো, ক্রমে তরিতরকারি, মাছ যাই থাকুক। এর কারণ হলো ওর চেয়ে বড় একটা ছেলেকে ও ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিল, যে ওকে সবসময় জ্বালাতন করত।
এই সমস্যার সমাধান করার পর তার বাবা তার একটা সমস্যা সমাধানে নামলেন। বাচ্চা ছেলেটি প্রায়ই বিছানা ভিজিয়ে ফেলত।
বাচ্চাটি ঘুমোত ওর ঠাকুমার কাছে। সকাল বেলায় ঠাকুমা উঠে বিছানার অবস্থা লক্ষ্য করে ওকে বলতেন, ‘দেখ জনি, রাত্তিরে আবার কি করছি।’
ছেলেটা জবাব দিত : না না, আমি করিনি, তুমি করেছ।
ওকে বকুনি দিয়ে, মারধর করে নানা রকমে বুঝিয়ে সুঝিয়েও কিন্তু বিছানা শুকনো রাখা যাচ্ছিল না। অতএব তার বাবা মা স্বভাবতই প্রশ্ন তুললেন : ‘ছেলেটাকে দিয়ে কেমন করে এই নোঙরা কাজ বন্ধ করাব?
ছেলেটার ইচ্ছেটা কি ছিল? প্রথমত সে চাইত তার বাবার মত পাজামা পরতে, ঠাকুমার মত রাতের গাউন তার একটুও ভালো লাগতো না। ঠাকুমা ওই বিছানা ভেজান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, অতএব নাতির জন্যে রাতের পাজামা এসে গেল বেশ আনন্দের সঙ্গেই। আশা ছিল যদিও বদলে যায়। দ্বিতীয়তঃ ছেলেটি আরও চাইত নিজের একটা বিছানা। ঠাকুমা তাতেও আপত্তি করলেন না।
ওর মা ওকে ব্রুকলীনের একটা বড় দোকানে নিয়ে গিয়ে সেলস গার্লকে চোখ টিপে বললেন : ‘এই ছোট্ট ভদ্রলোক কিছু কেনাকাটা করবেন।’
মেয়েটিও ওর শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগাতে চেয়ে বলল, বল, তোমাকে কী দেখাব?
ছেলেটি পা উঁচু করে একটু লম্বা হয়ে বলল, আমি আমার জন্য একটা বিছানা চাই।
ওর মা মেয়েটিকে একটা বিছানা দেখিয়ে চোখ টিপলেন। আর ছেলেটিকে সে সেটাই পছন্দ করাল। আর তাই কেনাও হয়ে গেল।
বিছানাটি পরের দিন পৌঁছে গেল বাড়িতে। রাতের বেলা বাবা বাড়িতে আসতেই ছেলেটি দরজার কাছে এসে চিৎকার করে বলল, বাবা! উপরে এসে আমার বিছানা দেখে যাও, আমি নিজে কিনেছি।
বাবা চার্লস্ শোয়াবের কথাটাই মেনে চললেন। অর্থাৎ দারুণ খুশি হয়ে প্রশংসা করে চললেন ক্ষুদে ভদ্রলোকের।
‘এ বিছানাটা নিশ্চয়ই ভেজাবে না, কী বলো?’ বাবা এবার বললেন।
‘ওঃ না, না। কখনও এ বিছানা ভেজাব না।’ ছেলেটি অবশ্যই তার কথা রেখেছিল যেহেতু তার গর্ব এর উপর নির্ভর করছিল। বিছানাটা যে ওর নিজের। তাছাড়া সে এক খুদে ভদ্রলোকের মত পায়জামাও পরেছিল। সে তাই বড়সড় একজন মানুষের মত ব্যবহার করতে চাইছিল। আর তা করেও ছিল।
আর একজন বাবা যিনি টেলিফোন ইঞ্জিনিয়ার, আমারই একজন ছাত্র তার তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে দারুণ সমস্যায় পড়েন। মেয়েটি তার প্রাতরাশ খেতে চাইত না একেবারেই। নানা রকম বকাবকি, অনুরোধ কোন কিছুতেই কাজ হল না। অতএব তার বাবা মা স্বভাবতই প্রশ্ন করলেন : ‘কি করে আমাদের ছোট্ট মেয়েকে প্রাতরাশ খাওয়াব?’