এমন কি মহারাণী ভিক্টোরিয়াও তোষামোদপ্রিয়া ছিলেন। ডিসরেলী স্বীকার করেছিলেন যে রাণীর সঙ্গে কাজকর্ম করার সময় তিনি এ কাজটা বেশ চমৎকার ভাবেই করতেন। তার ঠিক নিজের ভাষায় ব্যাপারটা ছিল এই রকম, ‘… বেশ চমৎকার করে তোষামোদের প্রলেপ লাগাতাম। এটাও জানা কথা ডিসরেলী ছিলেন বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ, নিখুঁত আর ধুরন্ধর একজন মানুষ। নিজের জগতে তিনি ছিলেন একজন পাকা লোক। তার পক্ষে যে কাজ করা সহজ ছিল সেটা আমার বা আপনার পক্ষে কাজের হবে না। শেষ পর্যন্ত এই তোষামোদ ভালো করার চেয়ে আপনার ঢের বেশি ক্ষতিই করতে পারে। তোষামোদ হলো অনেকটা জাল টাকার মত আর জাল টাকার মতই তা আপনাকে সেটা চালাতে গেলে বিপদে ফেলবে।
তাহলে প্রশংসা আর তোষামোদের মধ্যে তফাৎ কি? খুবই সহজ। একটা হলো আন্তরিক আর অন্যটা হলো কপটতা মাখানো। একটার উৎপত্তি হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আর অন্যটা সম্পূর্ণ বানানো। একটা স্বার্থপরতা মুক্ত আর অন্যটা স্বার্থপরতা জড়ানো। একটিকে সারা পৃথিবীই প্রশংসা করে আর অন্যটাকে সারা দুনিয়া ঘৃণা করে।
আমি কিছু দিন আগে মেক্সিকো সিটির ক্যাপশটেপেক প্রাসাদে জেনারেল ওব্রেগণের একটা আবক্ষ মূর্তি দেখে এসেছি। মূর্তির নিচে জেনারেল ওব্রেগণের জীবন দর্শন থেকে এই কথাগুলো খোদাই করা আছে : ‘যে শত্রু আপনাকে আক্রমণ করছে তাকে ভয় পাবেন না। যে বন্ধুরা আপনাকে তোষামোদ করে তাদের সম্পর্কে সাবধান থাকুন।
না! না! না! আমি তোষামোদের হয়ে ওকালতি করছি না। এর ধারে কাছেও আমি যাচ্ছি না। আমি শুধু এক নতুনজীবন প্রবাহের কথাই বলছি। আমাকে আবার বলতে দিন-’আমি এক নতুন জীবন প্রবাহের কথাই বলছি।
রাজা পঞ্চম জর্জ বাকিংহাম প্রসাদে তাঁর স্টাডি কক্ষে ছয়টি নীতিবাক্য টাঙিয়ে রেখেছিলেন। একটি নীতিবাক্য হলো : ‘সস্তা তোষামোদ করতে বা পেতে যেন শিক্ষা না পাই।’ এটাই আসল কথা, তোষামোদ হলো সস্তা প্রশংসা। একবার তোষামোদের চমৎকার একটা অর্থ শুনেছিলাম। সেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না : ‘তোষামোদ হলো লোকটি আসলে নিজের সম্পর্কে কি ভাবে সেটাই বলে দেওয়া।’
আমরা যদি সবাই তোষামোদ করতে চাইতাম, তাহলে সবাই সেটা গ্রহণ করে কাজ করতো আর আমরাও মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে রপ্ত হয়ে উঠতাম। আমরা যখন কোন বিশেষ সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাই না, আমরা সাধারণত আমাদের ভাবনার শতকরা ৯৫ ভাগই নিজের সম্বন্ধে ভেবে কাটাই।
এখন কিছুক্ষণের জন্যও যদি নিজেদের সম্বন্ধে আমরা ভাবনা বন্ধ করি আর অন্য সবাইয়ের ভালো ভালো ব্যাপারে ভাবতে শুরু করি তাহলে আমাদের ওই সস্তা আর মিথ্যে তোষামোদ রপ্ত করা দরকার হবে না। সেটা প্রায় মুখ থেকে বের করার আগেই লোকে জেনে ফেলবে।
এমার্সন বলেছিলেন : ‘যেসব মানুষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে তারা সবাই কোন না কোনভাবে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এর মধ্য দিয়েই আমি তার সম্পর্কে জানতে পারি।’
এটা যদি এমার্সনের ক্ষেত্রে সত্য হয় তাহলে কি তা আমার বা আপনার ক্ষেত্রে হাজার গুণ বেশি সত্য হয়ে উঠবে না? আসুন, আমাদের কাজ কর্ম আর চাহিদা নিয়ে চিন্তা ভাবনা বন্ধ করি আর চেষ্টা করি অন্য সবাইয়ের সদগুণ নিয়ে। তোষামোদ ব্যাপারটাও ভুলে যান। শুধু আন্তরিক আর ভালো প্রশংসা করতে থাকুন। অন্যকে সমর্থনের বেলায় হাসিমুখে সেটা করুন আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠুন তাহলেই দেখবেন মানুষ আপনার কথা মনে রাখবে আর সেটা আঁকড়ে রেখে সারাজীবন বারবার বলেও চলবে–আপনি তা ভুলে গেলেও বহু বছর পরেও তারা সেটা মনে রাখবে।
০৩. অন্যকে আপনার সঙ্গী করুন–নয় তো একলা চলতে হবে
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অন্যকে আপনার সঙ্গী করুন–নয় তো একলা চলতে হবে
প্রতিটি গ্রীষ্মকালেই আমি মেইনে মাছ ধরতে যাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি আবার স্ট্রবেরী আর ক্রীম খুবই ভালোবাসি, তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো মাছেরা ভালোবাসে পোকামাকড়। অতএব আমি মাছ ধরতে গেলে আমি আমার নিজের পছন্দের কথাটা ভাবিনা বরং মাছেরা কি চায় তাই ভাবি। বঁড়শিতে তাই স্ট্রবেরি বা ক্রীম না আটকিয়ে আমি লাগাই পোকামাকড় বা একটা ফড়িং তারপর মাছেদের বলি : ‘এটা পছন্দ হয়েছে?’
তাহলে মানুষ গাঁথতে গিয়ে এই সাধারণ বুদ্ধিটাই কাজে লাগান না কেন?
লয়েড জর্জ ও ঠিক এমনটি করেছিলেন। তাঁকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল যুদ্ধের সময় উইলসন, অর্ল্যাণ্ডো আর ক্লিমেন্সের মত নেতারা যখন বিস্মৃত আর ক্ষমতাচ্যুত হন তখন তিনি কেমন করে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় আসীন থেকেছেন। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে তার ক্ষমতার শীর্ষে থাকার কারণ একটাই, আর তা হলো তিনি শিখেছিলেন মাছ বুঝে চার ফেলা চাই।
আমরা যা চাই তা নিয়ে আলোচনা কেন? এটা ছেলেমানুষী অবাস্তব কাজ। এটা অবশ্য ঠিক আপনি যা চান তাতে আপনার আগ্রহ আছে, চিরকাল ধরেই সেটা আছে। কিন্তু আর কেউ তেমন আগ্রহশীল নয়। আমরা বাকি সবাই আপনারই মত, আমরা যা চাই তাতেই আমাদের আগ্রহ।
অতএব এ জগতটায় অন্য মানুষকে আগ্রহী করে তোলার উপায় হলো সে যা চায় সে সম্পর্কে কথা বলা আর কি করে সেটা সে পেতে পারে তা দেখিয়ে দেওয়া।
ভবিষ্যতে কাউকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিতে গেলে কথাটা মনে রাখবেন। ধরুন আপনি চান না আপনার ছেলে ধূমপান করুক, তাহলে তাকে উপদেশ দিতে যাবেন না বা আপনি যা চান বলবেন না। বরং তাকে দেখিয়ে দিন সিগারেট খেলে সে বেসবল টীমে সুযোগ না পেতে পারে বা একশ গজ দৌড়ে বিজয়ী না হতেও পারে।