প্রশ্নটা আমি কিছুদিন আগে আমাদের বিখ্যাত এক উন্মাদাগারের প্রধান চিকিৎসককে করেছিলাম। এই চিকিত্সক ভদ্রলোক উন্মাদ রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে উচ্চতম সম্মান আর অত্যন্ত লোভনীয় পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। তিনি খোলাখুলি আমাকে জানান যে মানুষ কেন উন্মাদ হয়ে যায় সেটা তিনি আদৌ জানেন না। আসলে নিশ্চিতভাবে এটা কেউই জানে না। তবে তিনি বলেন যে বহু লোক যারা পাগল হয়ে যায়, তারা এই পাগলামির মধ্যে একটা প্রাধান্য লাভ করার অনুভূতি খুঁজে পায়, যেটা রূঢ় বাস্তবে তারা পেতে ব্যর্থ হয়। তারপরেই তিনি নিম্নলিখিত কাহিনীটি শোনান :
বর্তমানে আমার হাতে একজন রোগিনী আছেন যাঁর জীবনে বিয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। তিনি চেয়েছিলেন ভালোবাসা, যৌন আনন্দ, সন্তান আর সামাজিক সম্মান। কিন্তু রূঢ় জীবন তার সব আশাই নষ্ট করে দেয়। তাঁর স্বামী তাকে ভালোবাসতেন না। এমন কি তাঁর সঙ্গে খেতেও তার আপত্তি ছিল। তিনি স্ত্রীকে উপরে তাঁর ঘরে খাবার দিতে বাধ্য করতেন। মহিলাটির কোন সন্তান বা সামাজিক সম্মান ছিল না। এর ফলে মহিলাটি পাগল হয়ে গেলেন এরপর কল্পনায় তিনি তাঁর স্বামীকে ডাইভোর্স করেন। কুমারী জীবনের নামও গ্রহণ করেন। তার এখন বিশ্বাস ইংল্যাণ্ডের অভিজাত সমাজে তার বিয়ে হয়েছে–আর নিজেকে তাই লেডি স্মিথ বলে ডাকার দাবীও করেন।
সন্তানের ব্যাপারে, তিনি কল্পনায় দেখেন প্রতিরাতেই তিনি এক একটি নতুন সন্তান লাভ করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই তিনি আমায় বলেন, ‘ডাক্তার, গত রাত্রিতে আমার একটা বাচ্চা হয়েছে।’
জীবন একবার তাঁর স্বপ্নের তরী বাস্তবের রূঢ় প্রস্তরের বুকে আছড়ে ভেঙে দিয়েছিল কিন্তু রৌদ্রকরোজ্জ্বল, কল্পনাময় বিচিত্র উন্মাদ জগৎটায় সেই ভাবনার তরী পাল তুলে তরতর করেই এগিয়ে চলে।
একে কি বিষাদময় বলবেন? এটা বলতে পারবো না। তার চিকিৎসক একবার আমাকে বলেন, ‘আমি যদি কোনভাবে হাত বাড়িয়ে ওঁর উন্মাদ অবস্থা দূর করে দিতে পারি তাহলেও সেটা করবো না। কারণ নিজের অবস্থাতেই উনি অনেক বেশী সুখী।‘
দল হিসেবে থাকলে পাগলেরা আপনার বা আমার চেয়ে ঢের সুখী। অনেকেই পাগল হয়ে আনন্দ উপভোগ করে চলে। করবে নাই বা কেন? তারা এইভাবে তাদের সমস্যা সমাধান করে ফেলে। এমন অবস্থায় থাকার সময় তারা বেশ মেজাজেই আপনাদের লক্ষ লক্ষ ডলারের চেক লিখে দেবে বা আগা খায়ের কাছে একটা পরিচয় পত্রও। তাদের স্বপ্নের জগৎটাতে তারা তৈরী করে নেয়। যে প্রাধান্য তারা হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরেছে সেটাই।
কোন মানুষ যে প্রাধান্যের অনুভূতির আকাঙক্ষায় পাগল পর্যন্ত হয়ে যায়, একবার ভেবে দেখুন আমি বা আপনি সুস্থ মানুষদের প্রকৃত প্রশংসা করে কি অলৌকিক ব্যাপারই না ঘটাতে পারি।
যতদূর জানি ইতিহাসে মাত্র দুজন মানুষই বছরে দশ লক্ষ ডলার মাইনে হিসেবে পেয়েছেন। তারা হলেন ওয়াল্টার ক্রাইসলার আর চার্লস শোয়াব।
অ্যান্ড্রু কার্নেগি শোয়াবকে বছরে দশ লক্ষ ডলার বা দৈনিক তিন হাজার ডলারের চেয়েও বেশি কেন দিয়ে যান? কেন?
কারণ শোয়াব দারুণ প্রতিভাবান? না। তবে কি ইস্পাত তৈরির কাজে তিনি অন্যের চেয়ে বেশি কিছু জানতেন? এও বাজে কথা। চার্লস্ শোয়ব নিজেই আমায় বলেছিলেন তাঁর নিচে বহুলোক কাজ করতো যারা ইস্পাত তৈরির ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বেশি জানতো। তাহলে?
.
শোয়াব বলেছেন যে তাঁকে ওই মাইনে দেওয়া হতো বিশেষ করে তাঁর মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের অদ্ভুত দক্ষতার জন্যই। আমি জানতে চেয়েছিলাম এটা তিনি কেমন করে করেন। নিচে তার নিজের মুখে জানানো সেই রহস্যের বিষয় জানাচ্ছি। এই কথাগুলো চিরকালীন সম্পদের মতই প্রতিটি বাড়ি, স্কুল, দোকান বা দেশের কর্মস্থলে ব্রোঞ্জে ঢালাই করে টাঙিয়ে রাখা উচিত। শিশুরা লাতিন ব্যাকরণের ক্রিয়ার গোড়ার কথা শিখতে গিয়ে বা ব্রাজিলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের কথা জানতে গিয়ে সময় নষ্ট করার বদলে মনে গেঁথে রাখবে–যে কথাগুলো শুধু মেনে চলতে পারলে আমার বা আপনার জীবন ধারাও পাল্টে দিতে পারে;
‘আমি মনে করি মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগিয়ে তোলার ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে আমার যা কিছু সম্পদ, শোয়াব বলেছিলেন। এটাই আমার সমস্ত ক্ষমতার গোড়ার কথা আর আমি মনে করি কোন মানুষের মধ্যের সেরা বস্তু আহরণ করার শ্রেষ্ঠ পথ হলো তাকে প্রশংসা করা আর উৎসাহ দেওয়া।
‘উপর মহলের কাছ থেকে নিম্ন পদস্থ লোকদের সমালোচনার মত আর কিছুই কোন মানুষের উচ্চাকাঙক্ষাকে এমনভাবে ক্ষতি করে না। আমি কাউকে সমালোচনা করি না। আমি কোন মানুষকে কাজ করার উৎসাহ দেওয়াতেই বিশ্বাসী। আমি তাই প্রশংসা করতেই উদ্বিগ্ন থাকতে অভ্যস্ত, আর দোষ খুঁজে পেতে আমি ঘৃণা করি। আমি যা পছন্দ করি তা হলো আমার কজে আমি আনন্দ লাভ করি আর প্রশংসা আমি দরাজ ভাবেই করি।’
ঠিক এটাই করেন শোয়াব। কিন্তু গড়পড়তা সাধারণ মানুষ কি করে? ঠিক এর উল্টোটাই। তাদের কোন কিছু পছন্দ না হলে তারা চিৎকার করে মরা মানুষকে জাগাতে চায় কিন্তু প্রশংসার কিছু থাকলে তারা মুখ খোলে না।
শোয়াব আরও বলেন, ‘আমার জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে সারা পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আমি এসেছি। আমি আজও পর্যন্ত এমন কোন মানুষ দেখিনি তারা যত নামী দামী মানুষই হোন না কেন প্রশংসা করলে ভালো কাজ করেন নি বা সমলোচনায় ক্ষুব্ধ হন নি এমন কাউকেই পাইনি।’