আবার এই আকাঙক্ষাই বহু ছেলেকে ডাকাত আর বন্দুকবাজ হওয়ার জন্য টেনে নিতে চায়। নিউইয়র্কের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার ই.পি. মালরুনি বলেন : ‘আজকের দিনে বেশির ভাগ তরুণ অপরাধীই বিশেষ অহমিকাবোধে আচ্ছন্ন, তাদের গ্রেপ্তার করার পর প্রধান অনুরোধ হয় সমস্ত সংবাদপত্রে তাদের বীরের আসনে বসিয়ে সব প্রকাশ করা। কিন্তু তাদের যে বৈদ্যুতিক চেয়ারে ভয়ঙ্কর মৃত্যু বরণ করতে হবে সে কথা আর তাদের মনে থাকে না। তারা শুধু কল্পনা করে নেয় তাদের ছবি ছাপা হবে বেবরুথ, লাগার্ডিয়া, আইনস্টাইন, লিণ্ডেনবার্গ, উসকানিনি বা রুজভেল্টের সঙ্গে। আপনি যদি বলেন কেমন করে শ্রেষ্ঠত্ববোধ অনুভব করেন তাহলে আমি বলে দিতে পারি আপনি কি ধরনের মানুষ। এটাই আপনার চরিত্র কেমন সেটাই জানিয়ে দেবে। আপনার সম্পর্কে এটাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন ধরুন জন ডি. রকফেলার তার শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি পেয়েছিলেন চীনের পিকিংয়ে একটা আধুনিক হাসপাতাল তৈরি করার জন্য টাকা দিয়ে। এ হাসপাতাল ছিল লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষের জন্য। যাঁদের তিনি জীবনে দেখেন নি বা দেখার সম্ভাবনাও ছিল না। অন্যদিকে ডিলিঞ্জার তার শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি পায় একজন ব্যাঙ্ক ডাকাত আর খুনী হয়ে। পুলিশ যখন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে মিনেসোটার একটা খামার বাড়িতে ঢুকে বলে, আমি ডিলিঞ্জার।’ সে যে জনগণের এক নম্বর শত্রু সেটা ভেবে সে গর্ব অনুভব করতো। সে আরও বলে, আমি আপনাদের কোন ক্ষতি করবো না, তবে আমি ডিলিঞ্জার।‘
একটা বিশেষ ব্যাপার হলো, ডিলিঞ্জার আর রকফেলারের মধ্যে প্রভেদ তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে পেয়েছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত সব মানুষদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য নানা প্রচেষ্টার মজাদার সব উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে। এমন কি জর্জ ওয়াশিংটনও চেয়েছিলেন তাঁকে ‘আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মহান প্রেসিডেন্ট বলে ডাকা হোক। কলম্বাস চেয়েছিলেন তাকে বলা হোক ‘মহাসমুদ্রের অধীশ্বর আর ভারতবর্ষের রাজপ্রতিনিধি। ক্যাথারিন দি গ্রেট ‘হার ইম্পিরিয়ার ম্যাজেষ্টি’ লেখা না থাকলে কোন চিঠি খুলতেন না। আবার, মিসেস লিঙ্কন হোয়াইট হাউসে মিসেস গ্রান্টকে তার সামনে বসার জন্য বাঘিনীর মতই চিৎকার করে বলেছিলেন, আপনার এতো দুঃসাহস আমি বসতে না বললেও আমার সামনে বসেছেন!
আমাদের দেশের কোটিপতিরা কুমেরু মহাদেশে অভিযান চালানোর জন্য টাকা দিয়েছিলেন এই শর্তে যে তুষার ঢাকা পর্বতমালার নামকরণ তাঁদের নামেই রাখা হবে। ভিক্টর হুগোও চেয়েছিলেন আরও বেশি–তার ইচ্ছা ছিল প্যারী শহরের নাম বদলে তার নামেই রাখা হোক। এমন কি শেক্সপীয়ার, সেই মহা শক্তিশালী লেখকও তাঁর পরিবারের জন্য পদক আর পুরস্কার প্রত্যাশা করতেন।
মানুষ আবার অনেক সময় সহানুভূতি আর নজর কেড়ে নেওয়ার জন্য শয্যাশায়ী হতে চায়, আর এটা করে তারা গুরুত্ব পেতে চায়। উদাহরণ হিসাবে মিসেস ম্যাকিনলের কথাটাই ধরুন। তিনি প্রাধান্য পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তার স্বামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রের জরুরী কাজ অবহেলা করে তাঁর দিকে নজর দিতে বাধ্য করেন। প্রেসিডেন্ট স্ত্রীর শয্যায় ঘন্টার পর ঘন্টা থেকে তাকে দুবাহু বেষ্টনে রেখে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। স্ত্রী তার দাঁত বাঁধানোর সময় আবদার করতেন স্বামী সারাক্ষণ তার পাশে থাকুন। একবার দাঁতের ডাক্তারের কাছে তাকে বসিয়ে রেখে প্রেসিডেন্ট জন হে’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ায় স্ত্রী বিশ্রী দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন।
মেরী রবার্টসন রাইনহার্ট আমাকে একবার বলেছিলেন চমৎকার স্বাস্থ্যবতী এক তরুণী গুরুত্ব বা প্রাধান্য অর্জনের জন্যই শুধু শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। মিসেস রাইনহার্ট বলেন, একদিন মেয়েটি কিছু উপলব্ধি হয় খুব সম্ভব ওর বয়স, আর যে সে কোনদিন বিয়ে করতে পারবে না সেই কথাটা। নিঃসঙ্গ দিন কাটাতে গিয়ে সে বুঝেছিল তার ভবিষ্যৎ বলে আর কিছুই নেই। সে তাই শয্যার আশ্রয় নিলো। তারপর দশ বছর তার বৃদ্ধা মা চারতলা থেকে বারবার উপর নিচে যাতায়াত করে ট্রে নিয়ে তার সেবা করে চললেন। অবশেষে একদিন বৃদ্ধা মা পরিশ্রমের ক্লান্তিতে মারা গেলেন। কটা সপ্তাহ মেয়েটি অসহায় ভঙ্গীতে পড়ে থাকার পর উঠে পড়তে বাধ্য হলো। তারপর পোশাক পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এল।
কোন কোন বিশেষজ্ঞর ধারণা যে মানুষ রূঢ় বাস্তব জগতে প্রধান্যের অনুভূতি লাভে ব্যর্থ হয়েই শেষ পর্যন্ত উন্মাদ জগতের স্বপ্নিল দুনিয়ায় প্রবেশ করে সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোয় মানসিক রোগের যত রোগী চিকিৎসায় আছে তার সংখ্যা অন্যান্য রোগাক্রান্ত রোগীর তুলনায় ঢের বেশি। আপনি যদি নিউইয়র্ক রাজ্যের অধিবাসী হন আর আপনার বয়স পনেরোর বেশি হয় তাহলে আপনার পাগল হয়ে সাত বছর কাটানোর সম্ভাবনা হলো কুড়িজনের মধ্যে একজন।
এরকম পাগল হওয়ার কারণ কি?
কারও পক্ষেই এরকম ঝটিতি উত্তর সম্ভব নয়, তবে আমরা জানি যে কিছু রোগ যেমন সিফিলিস, মস্তিষ্কের ক্ষতি কোষগুলো ভেঙে নষ্ট করে দেয় আর তার পরিণতিতেই আসে উন্মাদ রোগ। বাস্তবে, এই মানসিক রোগের অর্ধেকেই ঘটে নানা ধরনের শারীরিক কারণে, যেমন মস্তিষ্কের ক্ষতি, সুরা, টক্সিন বা আঘাত। কিন্তু বাকি অর্ধেকটা-এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর-বাকি যারা উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয় তাদের মস্তিষ্কের কোষে আপাত দৃষ্টিতে কোন গলদ থাকে না। ময়না তদন্তের সময় যখন উচ্চ ক্ষমতার অণুবীক্ষণের সাহায্যে মস্তিষ্কের ঝিল্লি পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা গেছে ওইসব কোষ আমার আমার আপনার মস্তিষ্কের মতই সজীব আর কর্মক্ষম। তাহলে পাগল হওয়ার আসল কারণ কী?