- বইয়ের নামঃ প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ
- লেখকের নামঃ ডেল কার্নেগি
- প্রকাশনাঃ বুকস্ ফেয়ার
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, আত্মজীবনী
প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ
০১. অন্যের সমালোচনা করবেন না
প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ
“কোন মানুষ যখন আন্তরিকভাবে কথা বলেন তখন তার কথায় যে রঙ ফোটে তা কোন যাদুকরও দেখাতে পারে না।”–আলেকজান্ডার উকট
“মানুষের মনের মধ্যে যে ধারণা আদর্শ বা উপসংহারের অস্তিত্ব থাকে তা সত্য, আর তা বাধাপ্রাপ্ত হয় শুধুমাত্র কোন বিরোধী ধারণা জেগে উঠলে তবেই।”–ওয়াল্টার ডিল স্কট
.
প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ – ডেল কার্নেগি
ভূমিকা
গত পঁয়ত্রিশ বছরে আমেরিকার প্রকাশনা জগৎ দু লাখের উপর নানা ধরনের বই প্রকাশ করেছেন। এর বেশির ভাগই অপাঠ্য আর অর্থকরী ভাবেও ব্যর্থ। অনেক বললাম বটে, আসলে একজন নামজাদা প্রকাশন প্রতিষ্ঠানের প্রধান আমায় বলেছেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠান ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতায় প্রতি আটখানি বই প্রকাশের পর সাতটিতেই লোকসান দিয়ে চলে।
তাহলে, আমি আবার একখানা বই লেখার মত হঠকারিতা করছি কেন? আর এ বই লেখার পর আপনিই বা তা পড়তে যাবেন কেন?
দুটো প্রশ্নই যথার্থ, তাই আমিও এর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো।
প্রায় ১৯২২ সাল থেকেই আমি নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী আর পেশাদার স্ত্রী পুরুষের জন্য নানা ধরণের শিক্ষাদানের কাজ করে আসছি। প্রথম প্রথম আমি শুধু জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষা দিতাম–এই শিক্ষণ ব্যবস্থা বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বয়স্কদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আরও সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশের জন্যই, আর সেটা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে বা জনসমাবেশের সামনে যাই হোক।
তবে আস্তে আস্তে সময় কেটে চললে উপলদ্ধি করলাম এই প্রাপ্তবয়স্কদের আসলে যা দরকার তা হলো কথা বলার যোগ্যতা প্রাত্যহিক কাজে কর্মে আর সামাজিক যোগাযোগের ব্যাপারে জনসংযোগের জন্য তাদের আরও বেশি শিক্ষা দরকার।
আস্তে আস্তে আমি এটাও বুঝলাম আসলে এরকম কিছু শিক্ষা আমার নিজেরই একান্ত দরকার। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে দেখি বারবার কৌশল আর উপলব্ধির কি অভাবই আমার রয়ে গেছে এই ব্যাপারে। আহা! এমন একখানা বই যদি বিশ বছর আগে আমার হাতে পড়তো। তাহলে কি আশাতীত আশীর্বাদের ব্যাপারই না হতো।
জনসংযোগের কাজই বোধ হয় সবচেয়ে বড় সমস্যা, বিশেষ করে আপনি যদি ব্যবসাদার হন। আর এটা আপনি যদি গৃহকর্ত্রী, স্থপতি বা প্রযুক্তিবিদও হন তাহলেও সত্য। কয়েক বছর আগে শিক্ষকদের উন্নতির জন্য কার্নেগী ফাউণ্ডেশনের আনুকুল্যে এক অনুসন্ধানের ফলে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর অর্থপূর্ণ ব্যাপার প্রকাশ পায়-যে ব্যাপারটা পরে কার্নেগী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আরও গবেষণায় সমর্থিত হয়। এই গবেষণায় আরও প্রকাশ পায় যে ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মত কারিগরী বিষয়েও যে কোন মানুষের অর্থকরী সাফল্যের শতকরা ১৫ ভাগ নির্ভরশীল তার কারিগরী জ্ঞানে উপর আর প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ মানবিক জ্ঞানের উপর–এটা হলো তার ব্যক্তিত্ব আর মানুষকে পরিচালিত করার দক্ষতার উপর।
বেশ কয়েক বছর ধরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে আমি ফিলাডেলফিয়ার ইঞ্জিনীয়ার্স ক্লাব আর নিউইয়র্কের আমেরিকান ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারদের শিক্ষাদান করেছিলাম। প্রায় ১৫০০ ইঞ্জিনীয়ার আমার ওই শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তারা আমার কাছে আসেন যেহেতু তারা বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন যে ইঞ্জিনীয়ারিং দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি আয়ের মানুষেরা প্রায় যারা ইঞ্জিনীয়ারিং-এ অভিজ্ঞ তারা হন না। উদাহরণ হিসেবে, যে কেউ ইঞ্জিনীয়ানিং, হিসাবশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা বা অন্য যে কোন পেশাতেই সপ্তাহে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর ডলার ব্যয় করে কিছু প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জন করতে পারে। বাজারে এদের শ’য়ে শ’য়ে মেলে। কিন্তু যে লোকের প্রযুক্তিজ্ঞানের সঙ্গে মনোভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা, নেতৃত্ব দেবার শক্তি আর মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগানোর ক্ষমতা আছে–সেই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বেশি উপার্জনের ক্ষমতা রাখেন।
জন ডি. রকফেলার তার কর্মকাণ্ডের সেরা সময়ে ম্যাথু সি. ব্রাশ’কে বলেছিলেন যে, জনসংযোগের কাজে দক্ষতা চা বা কফি কেনার মতই কেনা যায়। আর আমি এই ক্ষমতার জন্য অন্য যে কোন বস্তুর চেয়ে বেশি ব্যয় করতে রাজি। আপনাদের কি মনে হয় না দেশের প্রতিটি কলেজেই এই ধরণের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে দামী এই ক্ষমতা বিকাশের ব্যবস্থা থাকা দরকার? কিন্তু দেশের অন্ততঃ একটা কলেজেও এই ধরণের কোন ব্যবহারিক, সহজবোধ্য প্রাপ্তবয়স্কের উপযোগী শিক্ষণ-ব্যবস্থা আছে কি না তা আমার এই বই লেখার সময় পর্যন্ত নজর এড়িয়ে গেছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আর সমস্ত ওয়াই. এম সি. এ. বিদ্যালয়গুলো প্রাপ্তবয়স্করা সত্যিই কি শিখতে আগ্রহী স্থির করার জন্য যুগ্মভাবে এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। এই সমীক্ষা চালাতে খরচ হয় ২৫০০০ হাজার ডলার আর সময় লাগে দু বছর। সমীক্ষার শেষ অংশ চালানো হয় কানেকটিকাটের মেরিডেনে। শহরটিকে বেছে নেওয়া হয় যেহেতু এটি বৈচিত্র্যময় কোন আমেরিকান শহর বলেই। মেরিডেনের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের ১৫৬টি প্রশ্নের জবাব দিতে অনুরোধ করা হয়–প্রশ্নগুলো ছিল এই ধরণের : আপনার পেশা কি? শিক্ষা কতদূর? আপনি অবসর সময় কিভাবে কাটান? আপনার আয় কত? আপনার শখ কি? আপনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি? সমস্যা কি রকম? কি ধরনের বিষয় আপনি পড়তে আগ্রহী?’ ইত্যাদি। ওই সমীক্ষায় প্রকাশ পায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রধান আগ্রহ স্বাস্থ্য সম্বন্ধে–আর তাদের দ্বিতীয় আগ্রহ হলো মানুষ, অর্থাৎ কিভাবে মানুষকে বোঝা যায় আর তাদের নিয়ে চলা যায়, কিভাবে তাদের নিজের মত গড়ে তোলা যায় আর কিভাবে অপরকে জয় করে স্বমতে আনা যায়।