তার শ্রোতারা সম্ভবত এই বাক্য শেষ হবার আগে তার দেয়া ঘরের সংখ্যা ভুলে গিয়েছিলেন। ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়! সুতরাং তারা চিন্তা করছিলেন তাঁর শেষ বাক্য যা তাদের মনকে করেছিল মোহিত।
তাঁর বক্তব্য কখনো-কখনো অর্থহীন হয়ে পড়লেও তিনি আবার উস্কানিতে পরিণত করতে সক্ষম ছিলেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকেরাই এ সব বাড়ির মালিক, তারা ”আমদানি করা সমাজতন্ত্র বা বোলশেভিজমের শিকার নয়,“ “ফিলাডেলফিয়াই হচ্ছে আমেরিকার স্বাধীনতার প্রশ্রবণ” “স্বাধীনতা। ম্যাজিকের মতো শব্দ এটি। এই শব্দ উচ্চারিত হলে সকল মানুষই হয় উদ্দীপ্ত। উক্তিটা এমন একটি শব্দ, এমন একটি অনুভূতি, যার জন্যে প্রাণ দিয়েছে লাখোলাখো লোক। এই স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পুনরুল্লেখ করে তিনি যখন বলেন, “এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার পতাকা প্রথম নির্মিত হয়; এটি সেই শহর যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি সেই শহর যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র স্বাক্ষরিত হয়। মুক্তি ঘন্টা, পবিত্র মিশন, আমেরিকার মূলমন্ত্র প্রচার, স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত রাখা, ওয়াশিংটন, লিংকন, থিওডোর রুজভেল্টের সরকারের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা জনমনে করতে হবে সঞ্চারিত, এটা তখন চরমে পৌঁছে, শ্রোতারা হন বিমোহিত, উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত।
বক্তা তাঁর এই বক্তব্যটি আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রণয়ন করেছিলেন এবং শ্রোতা সমীপে পেশকালেও তিনি তাতে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। এই কারণেই তার এই বক্তৃতা শ্রোতাদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়। এতে অনেক দুর্বল পয়েন্ট, দুর্বল দিক থাকা সত্ত্বেও বক্তার বক্তৃতা পেশের কৌশল এটাকে একটি শ্রেষ্ঠ বক্তৃতায় পরিণত করে। এই বক্তৃতা শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতে, অনুপ্রাণিত করতে, তন্ময় করতে, বিমোহিত করতে সক্ষম হয়। ফলে এই বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়, শিকাগো কাপ পুরস্কার লাভ করে।
ডক্টর কনওয়েল যেভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :
বক্তৃতা প্রণয়নের কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম কানুন প্রচলিত নেই, তা আমি আগে বলেছি। এর কোনো ডিজাইন বা স্কীম অথবা চার্ট নেই বা বক্তারা অনুসরণ করতে পারেন। তবু বিভিন্ন বক্তা যে সব নিয়ম অনুসরণ করেছেন তা অনুকরণ করলে কিছুটা উপকার হতে পারে।
খ্যাতনামা লেখক প্রয়াত ডক্টর রাসেল এইচ, কনওয়েল বক্তৃতা প্রণয়নে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন এ প্রসঙ্গে তা বলছি। একদা তিনি আমাকে তার খ্যাতনামা বক্তৃতা প্রণয়নের রূপরেখা বলেন। তা নিম্নরূপ–
(১) তথ্য প্রকাশ করা।
(২) এর ভিত্তিতে যুক্তি প্রদর্শন।
(৩) অতঃপর কাজের জন্য আহ্বান জানানো।
বহুলোক এই পরিকল্পনাকে নিজেদের জীবনে অত্যন্ত ফলপ্রসু ও উপকারী বলে বর্ণনা করেছেন।
(১) যেটা ভুল সেটা প্রকাশ কর।
(২) এর প্রতিকারের পথ বল।
(৩) প্রতিকারে সহযোগিতা কামনা কর।
অথবা এটিকে অন্যভাবে বলা যায় :
(১) বর্তমানে এই অবস্থা বিদ্যমান যার প্রতিকার প্রয়োজন।
(২) আমরা এই বিষয়ে এই করতে চাই।
(৩) সুতরাং যেই কাজে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এই কাঠামোকে নিম্নলিখিতভাবে গ্রহণ করা যায় :
(১) শ্রোতাদের নিজের বক্তব্যের প্রতি আকর্ষিত করুন।
(২) তাদের আস্থা অর্জন করুন।
(৩) তথ্য প্রকাশ করুন, আপনার প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন।
(৪) তাদের প্রতি কাজের বা সহযোগিতার আবেদন করুন।
খ্যাতনামা ব্যক্তিরা কীভাবে বক্তৃতা তৈরি করতেন :
প্রাক্তন সিনেটর আলবাট জে, বেভারিজ ‘দি আর্ট অব পাবলিক স্পিকিং’ নামে একটি ক্ষুদ্র বই লিখেছেন। বইটি ছোট হলেও বক্তৃতা শেখার ব্যাপারে অত্যন্ত ফলপ্রসু। ”বক্তাকে তার বিষয়ে মাস্টার হতে হবে, বলেছেন এই খ্যাতনামা রাজনীতিক।“ এর অর্থ হচ্ছে এই যে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সাজাতে হবে, পর্যবেক্ষণ করতে হবে, হজম করতে হবে, শুধুমাত্র একদিকের তথ্য নহে বিষয়টির ভালোমন্দ সকল দিকের তথ্য নিয়েই এরূপ করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে যে, যা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বাস্তব তথ্য, ধারণা প্রসূত তথ্য নয়, অথবা শোনা ঘটনা নয়। সত্যতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হবে।
সুতরাং প্রতিটি আইটেম চেক করতে হবে। পরীক্ষা করে নিতে হবে। এর-অর্থ নিশ্চিত হবার জন্যে কষ্টকর গবেষণা কাজ চালাতে হবে। তা হলে এর থেকে কী পাওয়া যাবে? আপনি কী জনগণকে তথ্য প্রদান, নির্দেশ দান এবং উপদেশ দিতে যাচ্ছেন না? আপনি কী নিজেকে একজন কর্তৃপক্ষ বলে তাদের সামনে পেশ করতে চাচ্ছেন না?
যে কোনো সমস্যার তথ্যাদি নিয়ে পর-পর সাজান, এগুলো নিয়ে নিজে নিজে চিন্তা করে সমাধান বের করুন। তাহলে আপনার বক্তব্যে স্বকীয়তা থাকবে, শক্তি থাকবে। নিজস্ব চিন্তায় আপনার মনে যা উদয় হবে তাই সাজিয়ে লিখে নিন, এই স্বকীয় বক্তব্য হবে শক্তিশালী আকর্ষণীয় বক্তৃতা।
অন্য কথায়, উভয় দিকের তথ্য তুলে ধরুন। অতঃপর সমস্যাদির সমাধান সম্পর্কে নিজ চিন্তা প্রসূত বক্তব্য পেশ করুন।
‘আমি শুরু করি’, বলেছেন উড্র উইলসন, তার অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে, কতগুলো বিষয়ের তালিকা নিয়ে, সেগুলো সম্পর্কে আমি বলতে চাই, এবং আমি সেগুলোকে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুযায়ী আমার মনের মধ্যে পর-পর সাজিয়ে নিই। অর্থাৎ আমি বিষয়গুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে নিই যাতে একটার সাথে অন্যটার বিষয়বস্তুগুলোর অমিল বা বৈসাদৃশ্য না হয়। অতঃপর আমি সেগুলো সঁট লিপিতে চিট করে নেই। আমি সঁট লিপিতে চিট করতে অভ্যস্ত। কেননা এতে সময়ের অপচয় হয় না। অতঃপর আমি এগুলো টাইপ করে নেই। প্রবচন বদলাই, বাক্য শুদ্ধ করি, চিন্তা করে করে নতুন নতুন বিষয় যোগ করি।