আমি অসংখ্য মানুষকে মুখস্থ করা ভাষণ শোনাতে দেখেছি। তবে এমন একজনকেও দেখিনি মুখস্থ করা ছেড়ে কেউ মানুষের মত আচরণ করে কথা বলেছেন। এটা করলেও তাঁকে মানবিক বলতে পারতাম। হয়তো এতে তার একটু অসুবিধা হত তবে তাতে কাজ হত।
লিঙ্কন একবার বলেছিলেন আমি কাউকে মুখস্থ করার উপদেশ শোনাতে দেখতে চাই না। আমি চাই সে খোলামেলা ভাবেই বক্তব্য রাখুক।’
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, যুদ্ধ হল একটা শিল্পকলা এবং বিজ্ঞানও। আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে তা ব্যর্থ হয়। বক্তৃতার ব্যাপারেও তাই। এটা অনেকটা ভ্রমণের মত। শুরু না করলে শেষ হয় না।
বক্তৃতার বিষয়বস্তু তৈরি করার কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই।
এমন কোন ছক নেই যা সব রকম সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবুও এমন একটা ব্যবস্থার কথা ডঃ রাসেল এইচ. কনওয়েল তার এভারস্ অব ডায়মণ্ড’ গ্রন্থে বলে গেছেন যা অনেকেরই কাজে লাগতে পারে।
কনওয়েল বলেছেন : ১। আপনারা জানা তথ্যগুলো গুছিয়ে বলুন। ২। এর ওপর আলোচনা করুন। ৩। এগুলো কাজে লাগাতে অনুরোধ করুন। এই পাঠক্রমে ছাত্ররা নিচের পদ্ধতি কার্যকর বলে অনুভব করেছেন ১। অন্যায় বা ভুল ধরিয়ে দিন। ২। প্রতিকারের পথটি দেখাতে চেষ্টা করুন। ৩। সহযোগিতার আবেদন রাখুন।
আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমন : ১। শ্রোতাদের আগ্রহী করে তুলুন। ২। তাদের বিশ্বাস অর্জন করুন। ৩। আপনার বক্তব্য রাখুন-শ্রোতাদের আপনার বক্তব্যের গুণাগুণ সম্বন্ধে অবহিত করুন। ৪। শ্রোতাদের কাছে এমনভাবে আবেদন রাখুন যাতে তারা উদ্বুদ্ধ হয়।
বন্ধুদের সঙ্গে রিহার্সেল দিন
যে বক্তব্য আপনি রাখতে চলেছেন সেটা ঠিক করে রেখেছেন তো? এটাই হল প্রথম ধাপ। যে বিষয়ে আপনি বলবেন মনস্থ করেছেন সুযোগ পেলেই প্রাত্যহিক জীবনে বন্ধুবান্ধব বা কর্মক্ষেত্রের সহযোগীদের সঙ্গে সেটা ঝালিয়ে নিন। এ এক নিখুঁত পদ্ধতি। এভাবে কথা বললে অন্য কারও কাছ থেকে নতুন কোন কিছু জানতেও পারেন, আর তা হবে অমূল্য।
সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী হন
বইয়ের গোড়াতেও এই বিষয় উল্লেখ করেছি। এটা অবশ্য করণীয়। কোন বিষয় বেছে নেওয়ার পর আপনাকে বিষয়ের মধ্যে একাত্ম হতে হবে। আপনার আচরণ এমন হবে যা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বক্তাদের যুগযুগ ধরে প্রেরণা জুগিয়েছে। আপনার উদ্দেশ্যের উপর আশা রাখতে হবে।
মনে রাখবেন আপনার বক্তব্যের মাঝখানে কোন ব্যাকরণগত ভুল বা এ ধরনের ত্রুটি থাকলেও সেদিকে নজর দেবেন না। নিজের উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই আপনার বক্তব্য শেষ করবেন। আপনার বক্তব্য শ্রোতাদের কতখানি আবিষ্ট রাখতে পারে সেটা দেখাই আপনার কর্তব্য। সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী হওয়াই আপনার প্রয়োজন। সেটাই করুন।
আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠুন
বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ প্রফেসর উইলিয়াম জেমস বলেছেন : ক্রিয়া অনুভূতিকে অনুসরণ করে চলে, কিন্তু বাস্তবে ক্রিয়া আর অনুভূতি একসঙ্গেই চলে। যা ইচ্ছার অনুবর্তী, তাই ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমরা পরোক্ষভাবে অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
‘অতএব মনে সাহস আনতে হলে আমাদের এখন ব্যবহার করতে হবে যাতে আমাদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি। আর এটা করলেই ভয় দূর হয়ে যাবে।’
আপনাকে তাই প্রফেসর জেমসের উপদেশ কাজে লাগাতে হবে। যখন শ্রোতাদের সামনে এসে সাহস আনতে চাইবেন তখন এমন ভাব করুন যেন কিছুই হয়নি। অবশ্য আপনি তৈরী না থাকলে পৃথিবীর সমস্ত ইচ্ছাশক্তিতেও কাজ হবে না। কিন্তু যদি কি বললেন জানা থাকে তাহলে বীর পদক্ষেপে এগিয়ে যান আর গভীরভাবে শ্বাস টেনে নিন। আসলে শ্রোতাদের মুখোমুখি হওয়ার আগে ত্রিশ সেকেণ্ড গভীর শ্বাস টানুন। অতিরিক্ত মাত্রার অক্সিজেন আপনাকে উজ্জীবিত করে মনে সাহস সঞ্চার করবে। এতে আপনার নার্ভাস ভাবটা চলে যাবে।
এবার শ্রোতাদের সামনে সটান দাঁড়িয়ে, যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে কথা আরম্ভ করুন। আপনার যদি মনে সন্দেহ থাকে এই দর্শন কোন কাজেই নয় তাহলে বলব আপনার ক্লাসের যে কোন সহপাঠির সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই আপনার মনের পরিবর্তন ঘটবে। যেহেতু আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। আপনাকে বিখ্যাত একজন আমেরিকানের উপদেশ শুনতে বলছি। তিনি সাহসের প্রতীক। একদিন তিনি অতি ভীরু মানুষ ছিলেন, অথচ কালে কালে হয়ে ওঠেন অত্যন্ত সাহসী, বিশ্বস্ত, শ্রোতাদের প্রিয় মানুষ। তিনি হলেন আমেরিকার একদা প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট।
তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ছোটবেলায় আমি রুগ্ন ছিলাম। তরুণ বয়সেও আমি ছিলাম নার্ভাস আর কোন কাজে সাহস পেতাম না। আমাকে তাই প্রচুর পরিশ্রম করে শরীর আর মন তাজা করতে হয়। ছেলে বয়সে একটা বইতে পড়েছিলাম এক ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন একজন নাবিককে কিভাবে নির্ভয় হতে হয় শেখাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষ কাজ করতে গিয়ে ভীত হয়। তাকে যা করতে হবে তা হল ভয়ের কথা না ভেবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এইভাবেই একদিন তাকে জয় করা সম্ভব হবে!
এই নীতির উপর নির্ভর করেই আমি এগিয়ে যাই। প্রথমে অনেক কিছুতেই আমার ভয় ছিল, গ্রিমলিভালুক থেকে বুনো ঘোড়া আর বন্দুকবাজ পর্যন্ত। কিন্তু ভয় পাবো না ভেবে এগিয়ে ক্রমে ভয় জয় করেছিলাম। ইচ্ছে করলেই যে কোন মানুষ এটা পারে।