ড্যানিয়েল ওয়েবন্টার বলেছিলেন অর্ধেক তৈরি হয়ে শ্রোতাদের সামনে যাওয়ার কথা ভাবলে মনে হয় অর্ধেক পোশাক পরে হাজির হয়েছি।
বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ মুখস্থ করবেন না
‘ভালোভাবে তৈরী’ বলতে কি জানি বলছি বক্তৃতাটা একদম মনে গেঁথে রাখবেন? এ প্রশ্নের উত্তর দেব বেশ জোরালো ভাবে ‘না’ বলে। নিজেদের অহমিকাকে রক্ষা করতে আর পাছে শ্রোতাদের সামনে কথা ভুলে যান সেই কারণে বহু বক্তা মুখস্থ করার ফাঁদে পা দেন। কোন ভাবে এই নেশার বশীভূত হলে বক্তা বরাবরের মতই সময় নষ্ট করার মধ্যে আর মঞ্চে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হন।
আমেরিকার সংবাদ ঘোষকদের ডীন এইচ. ভি. ক্যাপ্টেনবর্ণ যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তিনি এক বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। জেন্টলম্যান, দি কিং’ নামে একটা ছোট গল্প তিনি বেছে নিয়ে প্রায় শ’খানেক বার রিহার্সাল দিয়ে সেটা একেবারে কণ্ঠস্থ করে রাখেন। প্রতিযোগিতার দিন তিনি সব ভুলে গেলেন। শুধু ভুলে যাননি, তাঁর মন একদম শূন্যতায় ভরে গেল। ভয়ে তিনি একেবারে আধমরা। হতাশায় মরীয়া হয়ে তিনি মন থেকেই গল্পটা বলে গেলেন। তাঁর অবাক লাগল যখন বিচারকরা তাঁকেই প্রথম পুরস্কার দিলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাল্টেনবর্ণ আর কখনও কোন বক্তৃতা মুখস্থ করেন নি। তার ঘোষক জীবনে সাফল্যের এটাই হল গোপন পথ। সামান্য কিছু নোট রেখে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই, শ্রোতাদের সামনে কথা বলেন।
যে লোক আগে শিখে সেটা মুখস্থ করতে চান তিনি শুধু সময় আর শক্তিই ক্ষয় করেন আর এর পরিণতিতে আসে ব্যর্থতা। আমরা সারা জীবন ধরেই স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে কথা বলি। আমরা কথাগুলো আগে ভাবিনা, আমরা কেবল কিছু ধারণা করে রাখি, ব্যাস। আমাদের ধারণা স্পষ্ট হলে কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবেই অবচেতনায় যেভাবে শ্বাস নিই সেইভাবেই এসে পড়ে।
এ ব্যাপারটি এমন কি উইনষ্টন চার্চিলকেও বেশ কঠিন পথে শিখতে হয়। তরুণ বয়সে চার্চিল তার বক্তৃতা লিখে মুখস্থ করতেন। এরপর একদিন যখন তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে মুখস্থ করা ভাষণ দিচ্ছিলেন আচমকা তার সব গোলমাল হয়ে গেল। তার মনে একবারে অন্ধকার নেমে এল। বেশ হতচকিত হয়ে, তিনি অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। শেষ কথাগুলো তিনি বারবার বলতে লাগলেন আবার সব গোলমাল হয়ে মুখ লাল করে, তিনি বসে পড়লেন। সেই থেকে শেষ অবধি উইনষ্টন চার্চিল কোনদিনই আর মুখস্থ করা বক্তৃতা করেন নি।
আমরা যদি আমাদের ভাষণ বা কথার প্রতিটি শব্দ আগে মুখস্থ করে রাখি তাহলে সম্ভবতঃ শ্রোতাদের মুখোমুখি হলেই তা ভুলে যাব। যদি ভুলে নাও যাই তাহলে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ভাবেই তা বলে যাব। কেন? কারণ ওই বক্তৃতা আমাদের অন্তর থেকে আসবে না। আসবে স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে। লোকজনের সঙ্গে আমরা যখন একান্তে কথা বলি তখন আমরা ভাবি যা বলতে চাই, তারপর বলতে শুরু করলেই কথুলো আপনা আপনি বেরিয়ে আসে। সারা জীবনে সব সময় তাই করি আমরা। সেটা আজ বদলানোর দরকার কি? যদি আমরা আগে বক্তৃতা মুখস্থ করে রাখি তাহলে ভ্যান্স বুশনেলের অভিজ্ঞতাই আমাদের জুটবে।
ভ্যান্স প্যারীর বো আর্ট স্কুলের ছাত্র, পরে তিনি হন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান ইকুইটেবল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্ট। অনেক বছর আগে তাকে আহ্বান করা হয় সারা আমেরিকার দু হাজার বীমা সংক্রান্ত প্রতিনিধিদের সভায় ভাষণ দিতে। জীবন বীমার কাজে মাত্র দু’বছর থাকলেও তাঁকে বিশ মিনিট বলার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ভ্যান্স খুবই খুশি হলেন। ভাবলেন এতে তার সম্মান বাড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি বক্তৃতাটা লিখে মুখস্থ করে রাখলেন। আয়নার সামনে অন্ততঃ চল্লিশবার তিনি রিহার্সালও দিলেন। মুখ চোখের ভঙ্গী, কায়দা সবই তাঁর নিখুঁত মনে হল।
যাই হোক, তিনি যখন বক্তৃতা দেবার জন্য মঞ্চে উঠলেন তখন প্রচণ্ড ভয় পেলেন। তিনি একইভাবে শুরু করলেন ‘এই অনুষ্ঠানে আমার কাজ হ’ল…।’ ব্যাস এখানেই তিনি সব ভুলে গেলেন। তিনি আবার গোড়া থেকে শুরু করার চেষ্টা করলেন। অনেক কসরৎ করে আবার এগিয়ে গেলেন। বারবার তিনবার তিনি এরকম করলেন : মঞ্চটা চার ফিট উঁচু ছিল আর পিছন দিকে কোন রেলিঙ ছিল না চারবারের মাথায় তিনি যেই পিছিয়ে এলেন, তখনই উল্টে পড়ে একদম অদৃশ্য হয়ে গেলেন। শ্রোতারা হেসে লুটোপুটি খেতে লাগলেন ব্যাপার দেখে। একজন শ্রোতা চেয়ার থেকে উঠে উল্টে পড়ে মেঝেয় গড়াগড়ি খেতে লাগলেন। জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে কেউ এমন মজার দৃশ্য দেখে নি। এ ঘটনার সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল শ্রোতারা ধরেই নিয়েছিলেন এটা এক ধরনের অভিনয়। প্রাচীন কর্মীরা এখনও এটা নিয়ে সরস আলোচনা করে থাকেন।
কিন্তু বেচারি বক্তা ভ্যান্স বুশনেলের কি হল? ভ্যান্স বুশনেল আমায় বলেছিলেন এই ঘটনা তার জীবনের সবচেয়ে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি। তিনি এতই অপমানবোধ করেন যে পদত্যাগপত্র লিখে ফেলেন।
ভ্যান্স বুশনেলের উপরওয়ালারা তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিরস্ত করেন। তাঁরা তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করলেন। পরে ভ্যান্স বুশনেল তাঁর প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ বক্তা হয়ে ওঠেন। কিন্তু জীবনে তিনি আর বক্তৃতা মুখস্ত করেন নি। তার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জ্ঞানলাভ করি আসুন।