যখনই সুযোগ আসবে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট বক্তৃতা দেবার চেষ্টা করবেন। সুযোগ পেলে নামী কোন বক্তার বক্তৃতা শোনার চেষ্টাও করতে হবে। অর্থাৎ আপনাকে নিজেকেই কথা বলার, জনসংযোগের সুযোগটি খুঁজে নিতে হবে।
৪. লেগে থাকা চাই
আমরা যখনই কোন নতুন কিছু শিখিযেমন ধরা যাক ফরাসী ভাষা শেখা বা গলফ খেলা বা ধরুন জনগণের সামনে বক্তৃতা করা, সব বিষয়েই আমরা সমান তালে এগুতে পারি না। তাই ধীরে ধীরে আমাদের উন্নতি লাভও সম্ভব হয় না। ঢেউ যেভাবে আসে আমরা সেইভাবেই থেমে থেমে একটু একটু করে শিখি। তারপর বেশ কিছুদিন এক জায়গায় আটকে থাকি–আগেকার শেখা অনেকটা ভুলেও যাই। মনস্তাত্ত্বিকরা এই অবস্থাকে বলেন শিক্ষার বক্তৃতায় অধিত্যকা। জনসংযোগের ছাত্ররা প্রায়ই হয়তো এই রকম অধিত্যকায় আটকে যায়। শত কঠিন পরিশ্রমেও যেন তারা লড়তে পারেন। দুর্বল যারা তারা এ অবস্থায় হতাশায় হাল ছেড়েও দেয়। যারা কঠিন প্রত্যয় নিয়ে লেগে থাকতে সক্ষম তারা একদিন অবাক হয়ে দেখে আচমকা তারা যেন বাধার প্রাচীর পার হয়ে চমৎকার উন্নতি করেছে। অধিত্যকা পার হয়ে তারা যেন প্লেনে উঠতে সুরু করেছে। ব্যাপারটা যেন রাতারাতি ঘটে যায়। তাদের মধ্যে জেগে ওঠে স্বাভাবিকতা, আত্মবিশ্বাস আর শক্তি।
এ বইয়ে আগে যেমন বলা হয়েছে, জনসংযোগ শুরু করে কথা বলতে গিয়ে আপনি হয়তো গোড়ায় নিদারুণ ভয়, ধাক্কা বা স্নায়বিক দুর্বলতা বোধ করতে পারেন। শ্রোতাদের মখোমুখি হলেই এই ভাব দেখা দেওয়া সম্ভব। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞরাও শ্রোতাদের সামনে এমন বোধ করেন। পেড্রেভস্কি পিয়ানোর সামনে বসলেই নার্ভাস হয়ে পড়তেন। কিন্তু পিয়ানো বাজাতে আরম্ভ করার পর ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক হয়ে উঠতেন। পেড্রেভস্কির অভিজ্ঞতা আপনারও হতে পারে। শুধু যদি একাগ্রতা বজায় রাখতে পারেন, তাহলেই প্রথম দিকের ভীতি কাটানো সে রকম অসম্ভব হবে না। প্রাথমিক ভয় কাটাতে পারা মানেই অর্ধেকটা জয় করা। কথা বলার মুখে হয়তো কিছুটা ভয় লাগা স্বাভাবিক–কথা বলতে শুরু করুন দেখবেন একটু একটু করে সে ভয় কেটে গেছে। আনন্দের সঙ্গেই এরপর কথা বলে যেতে পারবেন।
একসময় এক তরুণ, আইন পাঠ করার জন্য ইচ্ছুক হয়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের কাছে উপদেশ চেয়ে চিঠি লিখেছিল। লিঙ্কন তাকে জবাবে লেখেন : ‘তুমি যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আইনবিদ হওয়ার মনস্থ করে থাকো তাহলে অর্ধেক কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে…সব সময় মনে রাখবে সাফল্য লাভ করার জন্য তোমার একান্ত বাসনাই অন্য সব কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লিঙ্কন একথা জানতেন। সারা জীবনে সেটাই ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা। অথচ সারা জীবনে একবছরের বেশি তিনি স্কুলে শিক্ষালাভ করতে পারেন নি। আর বই? লিঙ্কন একবার বলেছিলেন তাঁর বাড়ির পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে যেখানে যত বই ছিল সবই তিনি ধার করে পড়ে ফেলেছিলেন। তাঁর কেবিনে সারা রাত ধরে কাঠের আগুন জ্বলত। মাঝে মাঝে হাতের কাছে রাখা ছড়িতে আগুন উসকে দিতেন তিনি এবং সেই জ্বলন্ত কাঠের আগুনের আলোয় পড়ে যেতেন লিঙ্কন। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় পাশ ফিরে চোখে জল নিয়ে লিঙ্কন পাশে রাখা কোন বই নিয়ে আবার পড়ে চলতেন।
তিনি কখনও কখনও ত্রিশ মাইল পায়ে হেঁটে কোন বক্তার বক্তৃতা শুনতে যেতেন। সব রকম পথে হাঁটার অভ্যাস করতেন লিঙ্কন–অনেকক্ষেত্রে বনজঙ্গলে। যে কোন জায়গায় তিনি বক্তৃতা শোনার জন্য ছুটে যেতেন। তিনি বক্তৃতার নেশায় যোগ দিয়েছিলেন নিউ সালেমের বিতর্ক ক্লাবে–আর দিনরাত বক্তৃতা দান অনুশীলনী করে চলতেন। সে বক্তৃতা হত সাধারণত সমসাময়িক সমস্যা। মেয়েদের সামনে একটু লজ্জা পেতেন লিঙ্কন। মেরি টডের সঙ্গে প্রেমে পড়লে লিঙ্কন লজ্জায় বেশি কথা বলতে পারতেন না, পার্লারে বসে মেরীর কথাই শুনে যেতেন। অথচ আশ্চর্য কথা সেই মানুষই অনুশীলন আর প্রাণপাত চেষ্টায় হয়ে ওঠেন সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বক্তা আর সেকালের শ্রেষ্ঠ বক্তা সেনেটর ডগলাসের সমকক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী। এই মানুষটিই গেটিসবার্গে যে ভাষণদান করেন মানুষের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরেই লেখা থাকবে চিরকাল।
তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, নিজের প্রচণ্ড অসুবিধা আর জীবন সংগ্রাম সত্ত্বেও লিঙ্কন লিখেছেন অদম্য বাসনা থাকলে সে কাজের অর্ধেকই হয়ে যায়…।’
ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, হোয়াইট হলেন মধ্যে লিঙ্কনের বিশাল এক তৈলচিত্র টাঙানো আছে। প্রেসিডেন্ট থিয়োডোর রুজভেল্ট লিখেছেন : ‘যখন কোন ব্যাপারে সমস্যায় পড়ি, বা মেটানো বেশ কঠিন মনে হয়–আমি লিঙ্কনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি আমার জায়গায় থাকলে লিঙ্কন কি করতেন। আপনারা হয়তো ব্যাপারটা আশ্চর্য মনে করবেন। তবুও আমি দেখেছি আমার সমস্যা এতে অনেক হালকা হয়ে যায়।’
তাহলে আপনিও রুজভেল্টের মতো করুন না কেন? যখন কোন বক্তৃতা দেওয়ার সময় সমস্যায় আকীর্ণ হবেন লিঙ্কনের কথাই ভাবুন না কেন? তিনি ওই সময় কি করতেন? আপনি অবশ্যই জানেন তিনি কি করতেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটের নির্বাচনে তিনি স্টিফেন এ ডগলাসের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বলেন : ‘একবার কেন একশবার পরাজিত হলেও হাল ছাড়া উচিত নয়।