বিখ্যাত লেখক আর বক্তা, জন ম্যাসন ব্রাউন, যার সজীব বক্তৃতা সারা দেশে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, একরাত্রিতে তিনি বক্তৃতা দিতে যান। তাকে একজন পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
লোকটি ব্রাউনকে বললেন, ‘যা বলতে যাচ্ছেন তা নিয়ে ভাববেন না। আরাম করুন। বক্তৃতা তৈরি করে রাখা আমার পছন্দ নয়। এই তৈরি হওয়ায় কাজ হয় না, এতে সব ব্যাপারটারই মাধুর্য নষ্ট হয়ে যায়। আমি বক্তৃতা করার সময় একটা প্রেরণার অপেক্ষায় থাকি আর তাতে কখনও ব্যর্থ হই না।’
এমন চমৎকার কথাগুলো শুনে মিঃ ব্রাউন ভেবেছিলেন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাও এমনই সুন্দর হবে। কিন্তু যা ঘটল সেটা মিঃ ব্রাউন তার অ্যাকিউসটমড অ্যাজ আই অ্যাম’ বইতে বলেছেন। তার বন্ধু এইভাবে শুরু করেন :
‘ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি কি? আজ আপনাদের জন্য কিছু খারাপ সংবাদই এনেছি। আমরা চেয়েছিলাম আইজ্যাক এফ. মার্কোসন আপনাদের সামনে আজ বক্তৃতা দেবেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হওয়ায় আসতে পারেন নি। (হাততালি)। এরপর আমরা সেনেটর ব্লেডরিজকে আমন্ত্রণ করি বক্তৃতা দিতে … কিন্তু তিনি খুবই ব্যস্ত। (হাততালি)। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি কানসাস সিটির ড. লয়েড গ্লোগ্যানকে আনতে (হাততালি)। শেষ পর্যন্ত আমরা পেয়েছি–জন ম্যাসন ব্রাউনকে। (সব চুপচাপ)।
এই মারাত্মক কাণ্ড দেখে মি. ব্রাউন কেবল বলেছিলেন : আমার সেই প্রেরণাদায়ক বন্ধু যে আমার নামটা ঠিকঠাক বলতে পেরে ছিলেন তাই নেহাৎ সৌভাগ্য।’
এতে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই ভদ্রলোক প্রেরণা নিয়ে অতখানি নিশ্চিন্ত থাকা সত্বেও বন্ধুকে কতটা এগিয়ে নিতে পারতেন। চেষ্টা করলে ব্যাপারটা আরও মারাত্মক হতে পারত। পরিচিতি দিতে গিয়ে তিনি শ্ৰোতা আর বক্তা দুজনেরই প্রচণ্ড ক্ষতি করেন। অনেক সভাতেই সভার কর্তারা এভাবে ব্যর্থ হন আর শ্রোতা ও বক্তার প্রচণ্ড ক্ষতি করে বসেন।
কোন বক্তৃতা করার মুখবন্ধ আর পরিচিতি অনেকটা সামাজিক পরিচয়ে মতই উদ্দেশ্যে পূর্ণ থাকে। এতে শ্রোতা আর বক্তা কাছাকাছি আসতে পারেন, একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়াও গড়ে ওঠে এবং দুদলের মধ্যে একটা একাত্মতা তৈরি হয়। যিনি বলেন, আপনাকে কোন বক্তৃতা দিতে হবে না। শুধু বক্তাকে পরিচয় করালেই চলবে, তিনি ঠিক বলেন না। এটা জেনে রাখা সকলেরই উচিত যে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মুখবন্ধ যদি বক্তৃতা দেওয়া হয় তার মূল্য অনেকখানি। অনেকেই ভুল বশতঃ তাকে গুরুত্ব দেন না।
‘পরিচিতি’ কথাটা লাতিন কথা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। কথাটির অর্থ ভিতরের কথা জানানো। অর্থাৎ যে বক্তার পরিচয় দেওয়া হবে তার সব কথাই যেন শ্রোতারা জানতে পারেন। এর ফলে শ্রোতারা বক্তার সম্পর্কে আগ্রহী হবেন। তারা বুঝতে পারবেন যে বিষয়ে কথা বলা হবে বক্তা তার উপযুক্ত। অন্যভাবে বলা যায় ‘পরিচিতি’ হল শ্রোতাদের কাছে বিষয়বস্তু বিক্রী করা এবং তারই সঙ্গে বক্তাকেও। আর এ কাজ করা দরকার যত কম সময়ে সম্ভব।
এবার বলুন তাই কি সত্যিই করা হয়? কখনই না। দশ বারের মধ্যে অন্ততঃ ন’ বারই না। প্রতিটি পরিচিতিই হয়ে ওঠে দুর্বল, ক্ষমার অযোগ্য। একাজ করতে পারলে ঢের সমস্যারই হয়তো সমাধান হতে পারত।
বক্তা আর তার বক্তৃতার বিষয়ে পরিচিতির জন্য এবার কিছু সূত্র দিচ্ছি।
১. যা বলতে চান ভাল করে তৈরি রাখুন
পরিচয়জ্ঞাপক বক্তৃতা ছোট্ট হলেও, হয়তো মিনিট পাঁচেকই লাগে এতে, এটা ভাল মতই তৈরি করা দরকার। প্রথমে আপনাকে বিষয় নির্বাচন আর মালমশলা জোগাড় করতে হবে। এটা তিনটে বিষয়ে গাঁথা থাকবে : বক্তার বক্তব্য বিষয়, ওই বিষয়ে কথা বলার জন্যে বক্তার যোগ্যতা, আর তার নাম। মাঝে মাঝে চতুর্থ একটা বিষয় দরকার হয়–যে বিষয় বক্তা বেছে নিয়েছেন শ্রোতাদের কাছে তা কেন আদরণীয় হবে।
প্রথমেই আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে বক্তৃতার সঠিক শিরোনাম আপনি জানেন, আর বক্তা যে ওই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন। পরিচয় দানের মধ্যে কোন গলদ থাকা ব্যাপারটার মত আর কিছুই বক্তার কাছে বিরক্তিকর হতে পারে না। এতে আরও মনে হয় বক্তব্য বিষয়ে বক্তার অধিকারই যেন নেই। এটা এড়ানো যায় শুধু বক্তার সম্বন্ধে সব ভাল ভাবে জানা থাকলে আর বক্তব্য বিষয়ে বেশি কথা না বলে। তবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বে থাকলে বক্তব্য বিষয়ের শিরোনাম আপনার জানা থাকতেই হবে–সঠিক ভাবেই তা বলা চাই-শ্রোতাদের আগ্রহ জাগাতেই সেটা চাই। যদি সম্ভব হয় তাহলে সেটা সরাসরি বক্তার কাছ থেকেই সংগ্রহ করবেন। যদি কোন কারণে তৃতীয় কোন ব্যক্তির উপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে আগে ভাগেই একটা কাগজে সেটা লিখে রাখতে পারলে বক্তার কাছে যাচাই করে নিন।
তবে আপনার আসল দরকার বক্তার সমস্ত গুণাগুণ সম্পর্কে সঠিক একটা ধারণা। বক্তা যদি অত্যন্ত নামী কোন ব্যক্তি হয়ে থাকেন তাহলে তার সম্বন্ধে জেনে নেওয়া তেমন কঠিন কাজ হবে না। আসল কথা আপনার জ্ঞাতব্য বিষয় হবে বক্তার জীবনী, তাঁর কৃতিত্ব, তাঁর বক্তব্য বিষয়ে যথাযথ ধারণা ইত্যাদি। মোট কথা সবই যেন নির্ভুল তথ্য হয়।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমি একবার একজন নামকরা বক্তাকে–যিনি অনেক জানেন’-আইরিশ কবিকে পরিচয় করাতে দেখি। সেই আইরিশ কবি হলেন ডব্লিউ. বি. ইয়েটস। ইয়েটসের নিজের কবিতা পড়ার কথা ছিল। এর কয়েক বছর আগে ইয়েটস তাঁর কাব্য প্রতিভার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল পুরস্কার পান। আমার ধারণা শ্রোতাদের মধ্যে অন্তত শতকরা দশজনই জানতো না নোবেল পুরস্কারের মূল্য কতখানি। তাই দুটি বিষয়েই জানানো উচিত ছিল। অথচ সে ধার দিয়ে আদৌ না গিয়ে সভাপতি গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী আর কাব্য সম্বন্ধে বলে গেলেন।