শ্রোতাদের সামনে এমনভাবে বক্তৃতা করবেন না যাতে শ্রোতারা বুঝতে পারেন আপনি আগে থেকে বক্তৃতাটা নিখুঁত তৈরি করে এসেছেন। স্বাভাবিক ভাবে আপনার কথা হতে হবে যাতে শ্রোতারা আদৌ বুঝতে না পারেন এ বক্তৃতা আপনার পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তৈরি। একজন সত্যিকার ভাল বক্তা এ রকম করবেন না।
৪. আপনার কথায় মনপ্রাণ সঁপে দিন
প্রচেষ্টা আর আগ্রহ আপনার সাহায্যে আসবে। কোন লোক যখন তার আবেগের অনুসারী হয় তখন তার প্রকৃত সত্ত্বা নিজের উপরে এসে যায়। আবেগের উত্তাপ সমস্ত রকম বাধা দূর করে দেয়। বক্তা কাজ করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তিনি কথা বলেন স্বাভাবিকভাবে।
অতএব শেষ দিকে এই স্বর প্রমোশন ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় তাহলে আপনার মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া।
ডীন ব্রাউন একবার তাঁর লণ্ডনে দেয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, আমার একজন বন্ধু একবার কোন গির্জার অনুষ্ঠানে লণ্ডনে যেভাবে চমৎকার বর্ণনা দিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন তা কোনদিনই ভুলব না। সেই বন্ধুর নাম জর্জ ম্যাকডোনা। হিব্রুর একাদশ পরিচ্ছেদ পাঠ করার পর সে যেভাবে বিশ্বাস সম্বন্ধে বক্তব্য রাখল তাতে অবাক না হয়ে পারিনি। তার সমস্ত মন আর হৃদয় সে ঢেলে দিয়েছিল।
আসল রহস্য হল এটাই–সমস্ত হৃদয় সমর্পণ করা। তাসত্বেও বলব কথাটার যেন কোন মানে হয় না তাই বুঝি জনপ্রিয়ও নয়। সাধারণ বক্তারা চায় সহজ কোন নিয়ম বা কাজের পদ্ধতি।
এডমাণ্ড বার্ক চমৎকার যুক্তিগ্রাহ্য আর ভাষায় লালিত্য মেশানো সব বক্তৃতা রচনা করেছিলেন যে, সেসব আজও ক্লাসিক বলে সব কলেজে পড়ানো হয়। অথচ বার্ক বক্তা হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলেন। তাঁর ওই অপূর্ব বক্তৃতা তিনি নিজে শোনাতে পারতেন না। তাই হাউস অব কমন্স সভায় তাঁর নাম হয় সান্ধ্যভোজের ঘন্টা। বার্ক কথা বলতে উঠলেই অন্য সব সদস্যরা কাশতে শুরু করতেন আবার কেউ কেউ বেশ আরাম করে বসে ঝিমুতে আরম্ভ করতেন।
ভাষা ও ব্যাকরণ সম্বন্ধে অবহিত হোন
মার্ক টোয়েন কিভাবে চমৎকার ভাষা আয়ত্ত্ব করেছিলেন জানেন? অল্প বয়সে তিনি মিশোরী থেকে নেভাদা পর্যন্ত ধীরগতির যানবাহনে ঘুরে বেড়াতেন। এইভাবে বেড়ানোর সময় বেশি মালপত্র নেওয়া সম্ভব হত না। তাসত্ত্বেও মার্কটোয়েন সঙ্গে রাখতেন একখানা ওয়েবস্টারের বিশাল অভিধান। এর কারণ তিনি নিজের ভাষাজ্ঞান নির্ভুল করে তুলতে চাইলেন।
অভিধান পাঠ করা পিট আর লর্ড চ্যাথামেরও নেশা ছিল। তাঁরা অভিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠা প্রায় কণ্ঠস্ত করে ফেলেছিলেন। প্রতিটি খ্যাতনামা লেখক আর বক্তাও তাই করেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ইংরাজী ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা তিনি আমেরিকার তরফে করেছিলেন তাঁর সেই লেখা, সাহিত্যে চিরস্থায়ী হওয়ার যোগ্য। কিভাবে তিনি ভাষায় পারদর্শী হন তিনি নিজেই তা লিখে গেছেন :
‘আমার বাবা কখনও বাড়িতে ভুল উচ্চারণ বরদাস্ত করতেন না। কারও কোন ভুল হলেই তা সংশোধন করে দিতেন। কথাবার্তা বলার সময় তিনি আমাদের নতুন শব্দ প্রয়োগে উৎসাহ দিতেন আর তা মনে রাখতে বলতেন।’
বক্তাকে তাই তার ভাষাজ্ঞান বাড়ানোয় নজর দিতেই হবে। অভিধান তাকে প্রভূত সাহায্য করতে পারবে।
৫. কণ্ঠস্বর দৃঢ় নমনীয় করে তুলুন
আমরা যখন শ্রোতাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বক্তব্য তাদের কাছে পেশ করি তখন আমরা সাধারণভাবে কাজে লাগাই আমাদের কণ্ঠস্বর আর শরীরিক অনেক কিছু। আমরা কাঁধ নাচাই, হাত নাড়তে থাকি। ভূ তুলি, কণ্ঠস্বরও ওঠানামা করাই, কখনও ধীরে কখনও দ্রুতলয়ে কথা বলে যাই। এসবের প্রয়োজন বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়েই করতে হয়। তবে মনে রাখা দরকার এ সবই হল আসল কোন কারণ নয়। কণ্ঠস্বরে যে দোলা লাগে, তা ওঠানামা করে। এসবই হল আবেগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে–মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই কারণেই যে বিষয় সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল সেই বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখা দরকার। এই কারণেই আমরা সেই বিষয় নিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে একাত্ম হতে আগ্রহ বোধ করি।
যেহেতু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই যৌবনের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা আর দৃপ্ততা বাড়াতে থাকি, তখনই প্রয়োজন হতে থাকে কণ্ঠস্বরের উপর নির্ভরশীলতা। এটা দরকার শ্রোতাবৃন্দের সঙ্গে সংযোগ ধারাটি বজায় রাখার জন্যই।
একটা কথা এ বইয়ের পাঠকদের জেনে রাখা দরকার। তা হল, আমরা হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কণ্ঠস্বর জোরে বা আস্তে করতে থাকি। এর ফলে আমরা অসতর্ক হয়ে পড়ি। এই কারণেই এ বইয়ে বলতে চেয়েছি যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাব বজায় রেখে বক্তব্য রাখতে। এজন্য দরকার স্বভাবসিদ্ধ পথে আমাদের ধ্যানধারণা প্রকাশ করতে চাওয়া। কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, স্বরগ্রাম, গতি ইত্যাদির নিরীখে নিজেকে তৈরি করা ব্যাপারটা ভারি চমৎকার একটা পথ। এটা করা যায় একটা টেপ রেকর্ডারের সাহায্য নিয়ে। এছাড়াও করা যায় বন্ধু বান্ধবদের সাহায্য নিয়ে। যদি কোন অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য এ ব্যাপারে পাওয়া যায় তাহলে তো কোন প্রশ্নই নেই। শুধু বই পড়ে এবিষয়ে অভিজ্ঞতালাভ সম্ভব হয় না-এজন্য দরকার অভ্যাসও, না হলে শ্রোতাদের সামনে সমস্যায় পড়তে হয়।
১১. বক্তার পরিচিতি, উপস্থিতি আর পুরস্কার গ্রহণ
আপনাকে যখন জনগণের সামনে কিছু বলার জন্য ডাকা হয় তখন আপনি আর একজন বক্তাকে পরিচিত করাতে পারেন যিনি শ্রোতাদের মুগ্ধ ইত্যাদি করতে পারেন। আপনি হয়তো কোন প্রতিষ্ঠানের হয়ে থাকতে পারেন। তেরোর পরিচ্ছেদে আমি দীর্ঘ বক্তৃতা আয়ত্ত করার বিষয়ে বলব। আর এই পরিচ্ছেদে বলব বক্তব্যের পরিচিতি কিভাবে দিতে হয় সে সম্পর্কে। এ ছাড়াও আমি আপনাদের কিছু মূল্যবান সূত্র দেব কিভাবে নিজের উপস্থিতি সহজ করে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারা যায়।