বিখ্যাত রুশ চিত্রশিল্পী ব্রুলফ একবার একজন ছাত্রের আঁকা ছবি সংশোধন করে দেন। ছেলেটি পাল্টানো ছবি দেখে অবাক হয়ে বলে ওঠে : ‘কী আশ্চর্য! আপনি শুধু একটা আঁচড়েই ছবিটি একেবারে বদলে দিয়েছেন।’ ফ্রলফ উত্তর দেন : ‘শিল্প আঁচড় থেকেই জন্মায়।‘ বক্তৃতার ব্যাপারটাও তাই।
ইংরেজদের পার্লামেন্টের বিষয়ে একটা প্রাচীন প্রবাদ চালু আছে। সেটা হল কোন বিষয়ে নয়, সব কিছু নির্ভর করে একজন বক্তা কিভাবে সেটা বলেন তার উপর। বহুবছর আগে কথাটা বলেন কুইন্টিলিয়ান, ইংল্যাণ্ড যখন রোমের উপনিবেশ ছিল।
বিখ্যাত হেনরী ফোর্ড বলেছিলেন, সমস্ত ফোর্ডরা একই রকম, অথচ কোন দুজন ফোর্ড এক নয়। সূর্যের আলোয় প্রতিটি নতুন জীবনই নতুন কিছু।এর আগে এমন কিছু ছিল না, আর ভবিষ্যতেও হবে না। প্রত্যেক তরুণের তাই উচিত অন্যের চেয়ে আলাদা করে নিজেকে চিহ্নিত করতে। একজনের মধ্যে যে বিদ্যুৎ স্পর্শ আছে তাকে জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়েই তার গুরুত্ব প্রকাশ পায়।
জনসংযোগ আর বক্তৃতার ব্যাপারেও কথাটা প্রযোজ্য। আপনার মত আর কোন মানুষ নেই। কোটি কোটি মানুষের হাত, পা, নাক, চোখ, মুখ থাকে,অথচ তাদের কাউকেই আপনার মত দেখতে নয়। স্বাভাবিক ভঙ্গীতে আপনি যখন বক্তব্য রাখবেন অন্য কেউই আপনার মত পারবে না।
স্যার অলিভার লজ একজন আদর্শ বক্তা ছিলেন। তাঁর বিশেষত্ব ছিল টাক মাথা আর দাড়ি। অথচ তিনি লয়েড জর্জকে নকল করার চেষ্টা করলে কিছুতেই বিখ্যাত হতে পারতেন না।
আব্রাহাম লিঙ্কন আর সিনেটের স্টিফেন এ, ডগলাস ছিলেন দুটি আলাদা চরিত্র আর বৈশিষ্ট্যের মানুষ। ১৮৫৮ সালে আমেরিকায় তাদের মধ্যেই বোধ হয় সবচেয়ে বিখ্যাত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।
ডগলাস ছিলেন একজন সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষ। লিঙ্কন ছিলেন একদম বিপরীত। ডগলাসের ভাবভঙ্গী ছিল রুচিপূর্ণ। লিঙ্কনের মোটেও তা নয়। ডগলাসের মধ্যে কোন রকম রসাল ভাব থাকতো না, অথচ লিঙ্কন ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রসজ্ঞ বক্তা। ডগলাস কদাচিত হাসতেন। লিঙ্কন কথায় কথায় হেসে উদাহরণ রাখতেন, ডগলাস দ্রুত চিন্তা করতেন আর লিঙ্কনের মনের গতি ছিল অতি বীর।
অথচ এ ধরণের বিভিন্নতা আর বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও দুজনেই হয়ে উঠেছিলেন শ্রোতাদের কাছে একান্ত প্রিয় বক্তা। দুজনের প্রত্যেকেই নিজের বৈশিষ্ট্য দিয়ে শ্রোতার মন জয় করেন, কেউ কাউকে নকল করেন নি।
৩. শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলা
হাজার হাজার মানুষ যেমনভাবে কথা বলে সেই বিশেষ ভঙ্গী নিয় একটা উদাহরণ দিই আসুন। একবার আমি সুইজারল্যান্ড এলাকায় আল্পস পর্বতের কাছে মুরেন গ্রীষ্মবাসে ছিলাম। আমি লণ্ডনের কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত এক হোটেলে ছিলাম, আর তারা সাধারণতঃ লণ্ডন থেকে অতিথিদের জন্য কিছু কিছু বক্তৃতা পাঠাত। এদের মধ্যে একজন ছিলেন নামকরা ঔপন্যাসিক। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘উপন্যাসের ভবিষ্যত’। ঔপন্যাসিক ভদ্রমহিলা স্বীকার করেছিলেন লেখাটা সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই নেই-ওটা বলতে তার কোন রকম আগ্রহও নেই। যাই হোক লিখিত বক্তৃতাটায় একবার চোখ বুলিয়ে তিনি কিছু নোট করে নিলেন তারপর শ্রোতাদের সামনে উঠে দাঁড়ালেন। এবার শ্রোতাদের সম্পূর্ণ অগ্রআহ্য করে তাদের দিকে একদম না তাকিয়ে তিনি কখনও তার হাতের কাগজে, কখনও বা মেঝের দিকে, কখনও বা শ্রোতাদের মাথার উপর দিকে তাকিয়ে প্রাগৈতিহাসিক এক ভঙ্গীতে কি যে বলে গেলেন কে জানে?
ব্যাপার হল এটা বক্তৃতা দেবার কোন পদ্ধতিই নয়। এ হল স্বগতোক্তি, এর মধ্যে যোগাযোগের কোনরকম চিহ্নই থাকে না। অথচ ভাল বক্তৃতায় সেটাই প্রধান প্রয়োজন। এটা হল সংযোগ স্থাপন। শ্রোতাদের বোঝাতে হবে যে তাদের কাছে একটা যোগসূত্র রাখা হচ্ছে–বক্তার সঙ্গে তাদের হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করা চাই। যে বক্তৃতার কথা বললাম, এরকম বক্তৃতা গোবি মরুভূমির জনশূন্য প্রান্তরেই যদি দেওয়া যায় কোন জীবন্ত মানুষের সামনে, তার কোন দাম থাকে না।
কথা বলার কায়দার উপর নানা রকম সব বাজে কথা অনেকই বলেছেন। নানা রকম আইন কানুনের বেড়াজালেও তা ঢাকা। সব ব্যাপারটাই হাস্যকর। বিক্রয় প্রতিনিধিরা এ ধরণের নানা বই পাঠাগারগুলোয় হাতড়ে বেড়িয়েছেন, যার সবগুলোই বাজে।
বিশ শতকের পর এই ধরণের নানা স্কুল গজিয়ে উঠেছে। এর সবই আধুনিকতার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি
মার্ক টোয়েন যখন একবার নেভাদা মাইনিং স্কুলে একটা বক্তৃতা শেষ করেন তখন শ্রোতাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে : এটাই কি আপনার স্বাভাবিক বক্তৃতার স্বর?
শ্রোতারা ঠিক এটাই চান : আপনার স্বাভাবিক স্বর। এ ধরনের স্বাভাবিক স্বর লাভ করা যায় একমাত্র অনুশীলন কারা মধ্য দিয়ে। যখন অনুশীলন চালাবেন তখন মাঝে মাঝেই থেমে নিজেকে প্রশ্ন করবেন : ‘শোন হে! কিছু ভুল হল নাকি? ঠিক করে নাও।’ এবার শ্রোতাদের মধ্যে মনে মনে কাউকে বেছে নিয়ে তার সঙ্গে কাল্পনিক কথাবার্তা বলতে থাকুন। মনে ভাববেন যে আপনাকে কোন প্রশ্ন করেছে। আর আপনি তার উত্তর দিচ্ছেন। সে প্রশ্ন যে কোন রকমই হতে পারে।
স্যার অলিভার লজ নামে একজন বক্তাকে পরমাণু ও পৃথিবী সম্পর্কে বলতে বলেছিলাম। তিনি তার কথায় মগ্ন, একাত্ম হয়ে ছিলেন। এইভাবেই বক্তৃতায় আপনাকে একাত্ম হতে হবে।