এই পরিচ্ছেদে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেগুলো মেনে চললে আপনি একজন দক্ষ তাৎক্ষণিক বক্তা হতে পারেন। আপনি যা বলতে ইচ্ছুক তাকে মনে মনে দ্রুত লয়ে সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করুন . তারপর তাকে ভাষায় রূপান্তরিত করুন।
বিখ্যাত স্থপতি নির্মাণকারক বেল-গেডেস বলেন, ‘উঠে না দাঁড়ালে তার মনের চিন্তা ভাষায় রূপ দিতে পারে না। কোন জটিল বিষয়ে সহকর্মীদের জানাতে তিনি অনবরত পায়চারি করে থাকেন। এটা দেখা গেছে একবার শুরু করলে পরের কথা সহজেই এসে যায়।‘
আমাদের অনেকের বেলায় কিন্তু ব্যাপারটা আলাদা। আমরা উঠে দাঁড়ালে ঘাবড়ে যাই। কিন্তু চেষ্টা করলেই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।
১০. কথা বলার ধরন পাল্টানো
বিশ্বাস করবেন কি, সারা পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ রাখার জন্য আমরা চারটে পথই আছে জানি। এই চারটি
পথেই আমাদের মূল্যায়ন আর বিশ্লেষণ ঘটে। সেই চারটে পথ হল :
১। আমরা কি করি।
২। আমরা কেমন দেখতে।
৩। আমরা কি বলি।
৪। আমরা কিভাবে বলি।
জন-সংযোগের ক্ষেত্রে বক্তৃতা দান শেখানোর জন্য পাঠক্রম চালু করার সময় প্রথমে আমি কণ্ঠস্বর মার্জিত আর জোরালো গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রচুর অনুশীলনের বন্দোবস্ত রাখতাম। বেশ কিছুকাল এটা করার পর বুঝলাম এর কোন প্রয়োজন সত্যিই নেই, কারণ যারা রোজ তিন ও চার ঘন্টা সময় ব্যয় করতে পারেন তারাই এটা পারেন। সাধারণ মানুষ যারা জনসংযোগ চান তারা এত সময় ব্যয় করতে পারবেন না। আমি বুঝলাম জন্মদও কণ্ঠস্বরই সাধারণের পক্ষে যথেষ্ট। আমার সৌভাগ্য যে সময় থাকতেই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। আমি বরং বক্তাদের সাধারণ বক্তৃতাদানের ভয় মুক্ত করতে চেষ্টা চালালাম-এর ফলও হল আশ্চর্য রকম ভাল। এবার যা করণীয় সে কথাই বলব।
১. আত্মসচেতনার খোলস ছাড়ুন
আমার পাঠক্রমে একটা চেষ্টা চালানো হয় বয়স্ক আত্মসচেতন মানুষদের যতখানি সম্ভব মুক্ত ভাবনার মানুষ হয়ে উঠতে। প্রায় হাত জোড় করে তাই সব সদস্যদের অনুরোধ করি, তারা যেন দয়া করে তাদের খোলস ছেড়ে বাইরে আসার চেষ্টা করেন। তাদের বলি এরকম করলে দুনিয়া তাদের আদর করে কাছে টেনে নেবে। মার্শাল বাক যেমন যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন, ’ধারণাটা খুবই সহজ, তবে ঠিক মত কাজে লাগানোই কঠিন।’ এই কঠিন হয়ে থাকা কথাটা শুধু শারীরিক দিক থেকেই হয় না এটা মনের দিকেও থাকে। এ একটা বড় রকম বাধা।
শ্রোতাদের সামনে স্বাভাবিক থাকা তেমন সহজ নয় সন্দেহ নেই। অভিনেতারা কথাটা জানেন। আপনার বয়স যখন চার বছর ছিল তখন বোধ হয় অনায়াসেই কোন মঞ্চে উঠে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছেন, কিন্তু যখন আপনার বয়স চব্বিশ তখন মঞ্চে উঠলে অবস্থাটা কি রকম হয়? চারবছর বয়সে যে স্বাভাবিকতা ছিল তা কি আর অবশিষ্ট থাকে? না, আপনি তখন নিজেকে স্বভাবতই গুটিয়ে ফেলার অবস্থাতেই থাকবেন।
বয়স্কদের এইভাবে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শেখানো বেশ কঠিন কাজ না বলাই শ্রেয়। এটা শেখানোর সময় কথা বলার ফাঁকে বহুবার আমি কোন সদস্য বক্তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছি আর বলেছি, একজন স্বাভাবিক মানুষের মত কথা বলুন।’ বহুবারই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমায় বাড়ি ফিরতে হয়েছে। না, জেনে রাখবেন, কথাটা অত সহজ শোনাচ্ছে কাজে আদৌও তা নয়। . আমি আমার ক্লাসের পাঠক্রমে সদস্যদের কথা বলার ফাঁকে একটু অভিনয়ের ভঙ্গী করতে বলি। তারা এ রকম করার পর আশ্চর্য হয়ে দেখে কাজটা বোকার মত মনে হলেও নিজেদের করার পর তা আর মনে হয় না। ক্লাসের শ্রোতারাও অবাক না হয়ে পারে না।
একাজ করতে গেলে আপনি আসলে পাখির ডানা মেলার মতই মুক্ত বলে নিজেকে ভাবেন–আপনি তখন আর খাঁচায় বন্ধ থাকেন না। মানুষ কেন দল বেঁধে নাটক দেখতে ছোটে জানেন? এর একটা মাত্রই কারণ আছে–তারা তাদের মত মানুষকে, সামনে নির্ভয়ে মুক্ত হয়ে আবেগ ইত্যাদির প্রকাশ করতে দেখতে চায়।
২. অন্যের নকল করবেন না
আমরা সেই সব বক্তাকে প্রাণ দিয়ে প্রশংসা জানাই যারা চমুকারভাবে কথা বলেন আর নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় পান না বা ঘাবড়ে যান না। শ্রোতাদের সামনে তারা বেশ স্বাভাবিক।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে আমার সঙ্গে দুই ভাই, স্যার রস আর স্যার কিথ স্মিথের লণ্ডনে দেখা হয়। তাঁরা সবে মাত্র লণ্ডন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ঘোষিত পঞ্চান্ন হাজার ডলার পুরস্কার জিতে ছিলেন। তাঁরা সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সাড়া তুলেছিলেন আর রাজা তাদের নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।
ক্যাপ্টেন হার্লি নামে একজন বিখ্যাত লোকচিত্রী তাঁদের সঙ্গে নিয়ে চলচ্চিত্র তুলেছিলেন। আমি তাঁদের একটা ছবিসহ প্রমাণ বিষয়ক কথিকা লিখতে সাহায্য করি। তারা দিনের পর দিন কথিকাটি অনুশীলন করেছিলেন।
তাঁদের তিনজনের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম ছিল। পাশাপাশি বসে তাঁরা প্রায় অর্ধেক বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তারা একই বক্তব্য রেখে চলেছিলেন। তবুও তাঁদের বক্তব্য কিন্তু একই রকম শোনায় নি।
যে কোন বক্তব্যের মধ্যে শুধু সাজানো কথাগুলো ছাড়াও থাকে বাচনভঙ্গী–আর এরই দাম সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে যে রঙ আর রস থাকে তারই গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী হয়। আপনি যা বলেন তার চেয়ে কিভাবে বলেন সেটাই বিচার্য।