অর্থাৎ বলতে পারা যায় তারা একটা বক্তৃতাই শুনতে চেয়েছিল। আসলে সেন্ট পলও তাই ওখানে যান। খুব সম্ভব তিনি একটা পাথরের খণ্ডের দাঁড়িয়ে গোড়ায় একটু নার্ভাস হয়েই হাত কচলিয়ে, গলা সাফ করে বলতে আরম্ভ করেন। সবাই যা করে থাকে।
অবশ্য তিনি তাদের আমন্ত্রণের পদ্ধতিটা মোটেই জানতে পারেন নি। সেটা এই : নতুন মতবাদ … অদ্ভুত জিনিস মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে একেবারে বিষাক্ত বস্তু। প্রথমে তাকে এই মনোভাব তাদের মন থেকে দূর করতেই হবে। এটা থেকে গেলে পরস্পরবিরোধী ভাব বাড়তেই থাকবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। তিনি কিছুতেই সেরকম হতে দিতে পারবেন না। অতএব বেশ কৌশলে তাঁর শ্রোতারা যা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে সে কথা দিয়েই শুরু করতে হবে। এতে মতবিরোধ কমতে থাকবে। কিন্তু আরম্ভ করা যায় কিভাবে? এক মুহূর্ত ভাবলেন সেন্ট পল, তারপরেই তাঁর মাথায় চমৎকার একটা মতলব জেগে উঠতেই তিনি তাঁর অমর বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন “হে এথেন্সবাসীগণ, আমার মনে হয় আপনারা কুসংস্কারপ্রিয়।”
কোন কোন অনুবাদে আছে, আপনারা অত্যন্ত ধার্মিক। আমার মনে হয় এই কথাটাই ঠিক। তারা বহু দেবতার পূজা করত, অত্যন্ত ধার্মিকও ছিল। এটা করে তারা বেশ গর্বও করত। সেন্টপল তাদের প্রশংসা করায় তারা খুবই খুশি হল। তারা একটু একটু করে তার উপর খুশি হতে আরম্ভ করল। জনসংযোগের কাজে একটা নীতি হল কোন উদাহরণ দিয়ে নিজের বক্তব্য প্রমাণ করা। তিনি ঠিক তাই করলেন :
‘এখানে আসার সময় আপনাদের ভক্তির প্রমাণ পেয়েছি, একটা দেবীও দেখেছি, তাতে আছে : ‘অপরিচিত ঈশ্বরকে।
এতেই প্রমাণ হয় তারা সত্যিই অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তারা কোন একজন দেবতাকে পাছে অসম্মান জানানো হয় ভেবে একটা বেদী বানিয়ে সকলের প্রতিই সম্মান জানাতে চেয়েছিল। সেন্টপল তাই ওই দেবীর উল্লেখ করে জানান তিনি তাদের তোষামোদ করছেন না, তিনি যা বলছেন তা সত্যিকার দৃষ্টিতে দেখে নেওয়া প্রশংসার বাণী।
এবার সেন্টপলের ওই চমৎকার ভাবে শুরু করার কারণটাই বলছি : ‘অজ্ঞাতসারে আপনারা যাকে পূজা করছেন তাকেই আপনাদের কাছে উন্মুক্ত করছি।’
‘নতুন ধারণা … অদ্ভুত কিছু?’ কণামাত্রও না। সেন্ট পল সেখানে হাজির হয়ে শুধু ব্যাখ্য করতে চেয়েছিলেন তারা না জেনে যে ঈশ্বরের উপাসনা করছে তারই সম্পর্কে কিছু।
এরপর সেন্ট পল তাঁর যুক্তির নীতি আর ধারণা নিয়ে অনেক কথা বলে এথেন্সবাসীদের নিজস্ব গ্রীক কবিদের কিছু কবিতা ও আবৃত্তি করলেন-এতেই বাজীমাত করলেন। অনেকেই তাকে ব্যঙ্গ করলেও বাকিরা বলল, “আমরা আবার আপনার কথা শুনব।
অপরের মনে কিছু ঢোকাতে বা তাদের বিশ্বাস অর্জনে আমাদের সমস্যা হল এই; আমাদের ধারণাকে তাদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে কোনো রকমেই বিরোধী না জাগে। এমন ক্ষমতা যার থাকে তিনিই কথা বলায় দক্ষতা অর্জন করেন আর অপরকে প্রভাবিতও করতে পারেন।
আপনার জীবনের প্রায় প্রতিটি দিনেই আপনি নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে থাকেন যাদের সঙ্গে আপনার মতের মিল থাকে না। আপনি কি প্রায় সব সময়েই অন্যদের নিজের মতাবলম্বী করার প্রচেষ্টা চালাতে চান না? সে চেষ্টা নিশ্চয়ই আপনি চালান। বাড়িতে, অফিসে, সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে ইত্যাদি নানা জায়গায় চালান। এসব ক্ষেত্রে আপনার কৌশলকে কি বেশ খানিকটা উন্নত করা যায় না? কিভাবে তাহলে শুরু করবেন? লিঙ্কনের দক্ষতা আর ম্যাকমিলানের মত কৌশলে? তাই যদি হয় তাহলে আপনি সত্যই বেশ বড় কুটনীতিক আর দূরদর্শী। এক্ষেত্রে উড্রো উইলসনের কথাগুলো মনে রাখা দরকার। সেকথাগুলো এই : আপনি যদি আমার কাছে এসে বলেন, “আসুন, আমরা একসঙ্গে বসে পরামর্শ করি–যদি আমাদের মতের অমিল থাকে, তাহলে, আসুন ভাবতে চেষ্টা করি এ অমিল কেন; এরকম হলে আমরা দেখব আমাদের মত বিরোধের সীমানা খুবই ছোট। আমাদের যদি একটু ধৈর্য থাকে আর সমাধানের ইচ্ছা থাকে তাহলে আমরা অনায়াসেই একসঙ্গে চলতে পারব।
০৯. তাৎক্ষণিক বক্তৃতা
খুব বেশিদিনের কথা নয়, একদল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর সরকারী আমলা কোন এক ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারের কাজকর্ম সম্পর্কে প্রশংসা করছিলেন। একের পর এক বক্তা গবেষণাগারে রসায়নবিদ আর গবেষকদের আশ্চর্যজনক কর্মধারার বর্ণনা করলেন। তারা শোনালেন গবেষকরা কিভাবে ছোঁয়াচে সব রোগের টীকা তৈরি করছেন, জীবানুর আক্রমণ-রোধে কিভাবে ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। তাদের পশু আর মানুষের উপর পরীক্ষা একেবারে নাটকীয়।
একজন সরকারী কর্মচারী রিসার্চ ডিরেক্টরকে বললেন আপনার লোকেরা সত্যিই যাদুকর। আপনি কিছু বলছেন না কেন।
‘আমি একা কথা বলতে পারি, লোকজনের সামনে পারি না’, ভদ্রলোক একটু দুঃখের সঙ্গেই বললেন।
কিছুক্ষণ পরে চেয়ারম্যান বলে উঠলেন, ‘আমরা কিন্তু এখনও আমাদের রিসার্চ ডিরেক্টরের কাছ থেকে কিছু শুনিনি। তিনি বক্তৃতা দিতে চাইছেন না। ঠিক আছে, আমরা তার কাছ থেকে অন্ততঃ দু’চারটে কথা শুনতে চাই।’
ব্যাপারটা ডিরেক্টরের কাছে ফ্যাসাদের মত হয়ে উঠল। তিনি কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে দু’চারটে কথা বললেন মাত্র। বেশি কথা বলতে না পারার জন্য তিনি ক্ষমা চইলেন–ব্যাস্, এইটুকুই তাঁর বক্তব্য ছিল।