৪. শ্রোতাদের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা দেখান
‘মানুষের ব্যক্তিসত্তা চায় ভালবাসা আর তাছাড়াও সম্মান’, বলেছিলেন ড. নরম্যান ভিনসেন্ট পীল। প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজের সম্পর্কে ধারণা, আত্মসম্মান আর গুরুত্ববোধ থাকে। সেই মানুষটির ওই ধারণায় একবার আঘাত করুন, দেখবেন চিরকালের মতই তাকে হারিয়েছেন। তাই যখনই কোন লোককে ভালবেসে শ্রদ্ধা জানাবেন, মনে রাখবেন সেও আপনাকে ততখানি ভালবাসবে আর শ্রদ্ধা জানাতে চাইবে।
‘আমি একবার কোন অনুষ্ঠানে একজন কমেডিয়ানের সঙ্গে ছিলাম। লোকটিকে তেমন ভাল করে জানতাম না। সেই সাক্ষাৎকারের সময় যখন জানতে পারলাম তিনি তার কাজে বেশ অসুবিধা বোধ করছেন, তখনই বুঝলাম কেন।
‘আমি তার পাশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”আপনি ভয় পাচ্ছেন না? তিনি জানতে চাইলেন।
‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমি জবাবে বললাম। শ্রোতাদের সামনে কথা বলতে আমি সব সময় একটু নার্ভাস বোধ করি। শ্রোতাদের সম্পর্কে আমার গভীর শ্রদ্ধা, তাই দায়িত্বের কথাটা ভাবলেই একটু ভয় লাগে। আপনি নার্ভাস হন না?’
‘না’, তিনি বললেন, ‘ভয় পাব কেন? শ্রোতাদের কাছে ভয় কি? তাদের সহজেই বাগানো যায়।
‘আপনার সঙ্গে আমি একমত নই, আমি বললাম। শ্রোতারাই আপনার আসল বিচারক। তাদের প্রতি আমার অপার শ্রদ্ধা আছে।
ডঃ পীল যখন ওই ভদ্রলোকের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে আসার কথা শুনলেন তিনি বুঝলেন এর কারণ রয়ে গেছিল ভদ্রলোকের শ্রোতাদের প্রতি ব্যবহারের মধ্যে। তিনি এতে অপরের অশ্রদ্ধাই জাগিয়ে তুলেছিলেন তাদের জয় করতে না চেয়ে। আমাদের মত যারা অন্যকে কিছু দিতে চায় তাদের কাছে এটা একটা মস্ত শিক্ষার বিষয়।
৫. বন্ধুত্বপূর্ণভাবে শুরু করুন
একবার এক নাস্তিক উইলিয়াম পেলীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ভগবান বলে কিছু নেই সে কথা অপ্রমাণ করতে। খুব শান্তভাবেই পেলী তার ঘড়িটা বের করলেন : আপনাদের যদি বলি ঘড়ির এই সব লিভার আর স্প্রিং নিজেরাই নিজেদের তৈরী করে চলতে আরম্ভ করেছে, তাহলে কি আপনি আমার বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না? অবশ্যই তা করবেন। একবার আকাশের তারাদের লক্ষ্য করুন। এদের প্রতিটিরই নিখুঁত গতিপথ আর গতিবেগ আছে-সূর্যের চারপাশের গ্রহমণ্ডল আর পৃথিবীর-এরা লক্ষ লক্ষ মাইল গতিতে যথানিয়মে পরিকল্পনা করে চলেছে। প্রত্যেক তারাই এক একটি সূর্য, আর তাদের নিজস্ব উপগ্রহও আছে, ঠিক আমাদের সৌরজগতের মত। অথচ কোন সংঘর্ষ নেই। কোন গণ্ডগোল নেই, কোন ভুল নেই। সবই শান্ত, নিখুঁত আর নিয়ন্ত্রিত। তাই এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে এসবই আপনা থেকেই হয় না কি অন্য কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করে?
ধরুন উনি এভাবে কথা না বলে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রথমেই বলে উঠতেন : ভগবান নেই? বোকার মত কথা বলবেন না কি বলছেন তা জানেন না।’ একথা বললে কি ঘটত? সন্দেহ নেই বেশ তর্কাতর্কি লেগে যেত-যেরকম কথা কাটাকাটি হত তাতে শেষ পর্যন্ত ফল কিছুই হত না। নাস্তিক ভদ্রলোক নিশ্চয়ই গরম হয়ে বুনো বিড়ালের মত ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কেন? কারণ তাঁর সযতে গড়ে তোলা মতটা যে চুরমার হয়ে যেতে বসেছে, তার অহঙ্কার নষ্ট হতে চলেছে।
মানুষের চরিত্রে এই অহমিকা একেবারে মৌলিক এক বৈশিষ্ট্য। তাহলে ওই বৈশিষ্ট্যকে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে না দিয়ে তাকে আমাদের সপক্ষে লাগাই না কেন? কিন্তু তা করব কিভাবে? ঠিক পেলী যা করেছিলেন সেইভাবে কথা বলে-অর্থাৎ আমাদের প্রতিপক্ষ যা বিশ্বাস করে তাই বলে। এর ফলে সে আপনার কথা বাতিল না করে বরং গ্রহণ করবে। এতে সংঘর্ষের পথ এড়ানো যায়।
পেলী দেখাতে চেয়েছিলেন মানুষের মন কীভাবে কাজ করে আর প্রশংসা কিভাবে গ্রহণ করে। বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটা মেনে চলেন না। তাদের ধারণা আক্রমণ করেই বোধ হয় অপরকে চট করে আয়ত্তে আনা যায়। এর ফলে কি ঘটে? খুবই সহজ ব্যাপার-যেই মাত্র মতবিরোধের সূত্রপাত ঘটে, মনের সমস্ত দরজা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় আর কথার লড়াই এবং মতপার্থক্য জন্ম নেয়। দুপক্ষের কেউই আর পরাজয় মানতে চায় না।
আমি এখানে যে মানার মত নিয়মের কথা বলতে চাই তা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। বহুঁকাল আগেই এটি সেন্ট পল কাজে লাগিয়ে ছিলেন। তিনি এটা কাজে লাগান মার্শ হিলে এথেন্সবাসীদের কাছে তাঁর বিখ্যাত ভাষণে–তাঁর সেই ভাষণ এমন চমৎকার আর পরচিত্তজয়ী ছিল যে আজও প্রায় উনিশ শতক পরেও আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। তাঁর শিক্ষা ছিল পুর্ণতাময়, খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর কৃতিত্বই তাঁর প্রধান সহায় হয়ে ওঠে। একদিন তিনি এথেন্সে উপস্থিত হলেন–পেরিক্লিসের পরবর্তীকালের এথেন্স, যে এথেন্স একদিন গৌরবের শিখরে উঠেছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার পতন ঘটে চলেছিল। ওই সময় সম্বন্ধে বাইবেলে বলা হয়েছে : সমস্ত এথেন্সবাসী আর বিদেশীরা, যারা ওখানেই থাকতেন প্রতিদিনই নতুন কিছু বলতেন বা শুনতেন।
সে সময় এথেন্সে রেডিও, টেলিগ্রাফ বা ডাক ব্যবস্থা ছিল না অথচ এথেন্সবাসীরা প্রত্যেকদিন বিকেলেই নতুন খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারত। তারপরেই সেন্ট পল হাজির হলেন। এটাও নতুন ঘটনা। তারা সবাই বেশ খুশী মনে, আনন্দেই তাঁকে আগ্রহ নিয়ে ঘিরে ধরল। তাকে এরোপাগানে নিয়ে গিয়ে তারা বলল : আপনার ওই নতুন চিন্তাধারা জিনিসটি একবার শুনতে পারি কি, যার কথা বলছেন? কারণ আমাদের কানে আপনি নতুন কথা ঢুকিয়েছেন, তাই আমরা এর অর্থ জানতে চাই।