অনেক স্কুলে পাঠ্য বইয়ে বলা হয় জনগণের সামনে বক্তৃতার ব্যাপারটা একটা বন্ধ শিল্প, যা শুধু বহুঁকাল চেষ্টায় কণ্ঠস্বর ঠিক করে ভাষায় অলঙ্কার জুড়েই করা যায়। আমি দীর্ঘকাল, প্রায় সারা জীবনই মানুষকে বুঝিয়েছি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার কাজ খুবই সহজ। শুধু কতকগুলো সহজ নিয়ম মেনে চললেই হল। ১৯১২ সালে যখন প্রথম এই শিক্ষাদান শুরু করি তখন প্রাথমিক ছাত্রের মত আমিও এর অর্থ জানতাম না। আমি প্রথমে যে শিক্ষাদান শুরু করি তা আমার কলেজী শিক্ষার উপর নির্ভর করে।
পরে দেখলাম ভুল পথে চলেছি। বয়স্কদের যে ভাবে শিক্ষা দিচ্ছিলাম তারা যেন নতুন কলেজ ছাত্র। আমি দেখলাম, আমি যে ওয়েবন্টার, বার্ড, পিট আর ওডোনেলকে নকল করতে বলেছি সেটা একেবারেই ভুল। আমার ক্লাসের ছাত্ররা যা চাইছিল তা হল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে পরিষ্কার গলায় ব্যবসা জগতের সভায় বক্তব্য রাখা। এরপর সব বই জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে কতকগুলো সহজ বিষয় নিয়ে ছাত্রদের মুখোমুখি হতে আমার দেরী হয় নি। এতেই কাজ হল আর ছাত্ররাও বেশি সংখ্যায় আসতে লাগল।
আমার অফিসের তাকে আর দুনিয়াময় শাখা অফিসে যে সব প্রশংসাপত্র জমিয়ে রাখা আছে সেগুলো যদি দেখতেন, আপনারা অবাক হয়ে যেতেন। এসব চিঠি এসেছে নামী সব শিল্প অধিকর্তার কাছ থেকে যাঁদের নাম সংবাদপত্রের শিরোণাম। এ ছাড়া এসেছে রাজ্যের গভর্ণর, পার্লামেন্টের সদস্য, কলেজের প্রেসিডেন্ট আর শিল্পী জগতের মানুষের কাছ থেকেও। শুধু এই নয়, আরও চিঠি পেয়েছি গৃহকর্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষক, কোম্পানী অধিকর্তা। শ্রমিক-দক্ষ ও অদক্ষ, ইউনিয়ন সদস্য। কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী মহিলা। এঁরা সকলেই চেয়েছেন জনগণের সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে গ্রহণীয় হতে। তারা সফলতা লাভ করায় কৃতজ্ঞতায় আমাকে সপ্রশংসা চিঠি না লিখে পারেন নি।
যে-সব হাজার হাজার মানুষকে আমি শিক্ষা দিয়েছি তার মধ্যে একজনের কথাই আমার মনে আসছে যেহেতু ব্যাপারটা সে সময় আমার উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। কয়েক বছর আগে ফিলাডেলফিয়ার একজন সফল ব্যবসায়ী ডি. ডব্লিউ. ঘেন্ট আমার পাঠক্রমে যোগ দেওয়ার পর আমাকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি আমায় বলেন : বহু সভায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আমি এড়িয়ে গিয়েছি মিঃ কার্নেগী। বর্তমানে আমি এক কলেজে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। সভায় তাই সভাপতিত্ব করতেই হবে। আপনি কি মনে করেন এই বয়সে বক্তৃতা শেখা সম্ভব?
আমি ওই বয়সের মানুষকে শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা থেকে জানালাম এটা নিশ্চয়ই সম্ভব আর তিনি সফল হবেনই।
তিন বছর পর তাঁর সঙ্গে আবার মঞ্চে যাই। প্রথম সাক্ষাতের সময় যে টেবিলে বসেছিলাম সেটাতেই আমরা বসি। আমি তার কাছে জানতে চাই আমার ভবিষ্যত বাণী ঠিক হয়েছে কি না। তিনি হেসে একটা নোট বই বের করে দেখালেন কতগুলো জায়গায় তিনি বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তিনি আরও বললেন, এই বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা, বক্তৃতা দান করে যে আনন্দ আমি পাই তার তুলনা নেই।
শুধু এই নয়–তিনি তুরুপের যে তাসটি এবার দেখালেন তা হল ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সভায় প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়েছে।
আর একটা উদাহরণ দিই। বি এফ, গুডরিচ কোম্পানী বোর্ডের চেয়ারম্যান এম গুডরিচ একদিন আমার অফিসে এসে বলেন, আমি সারা জীবনে যতবার বক্তৃতা দিতে চেয়েছি ততবারই ভয়ে কেঁপেছি। বরাবর বোর্ডের সভায় সভাপতিত্ব করেছি আর বসে বসে কথা বলেছি। কিন্তু যখনই দাঁড়িয়ে বলতে হয়েছে ভয়ে কেঁপে উঠেছি। মুখ দিয়ে যেন কথাই বেরোতে চায়নি। আমার বিশ্বাস হয় না কিছু করতে পারবেন এ ব্যাপারে। আমার সমস্যা বড়ই জটিল।
‘কিন্তু’, আমি বললাম, ‘আমি কিছু করতে পারবো না বুঝলেও এসেছেন কেন?’
‘শুধু একটা কারণে’, তিনি জবাব দিলেন। আমার একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছে। লোকটা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। আমার চেম্বার পার হয়ে যাওয়ার সময় সে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকত, কদাচিৎ মুখ তুলতো। আচমকা দেখলাম সে আমার ঘরে সোজা চিবুক উঁচু করে ঢুকছে আর আমাকে উজ্জল মুখে বলল, ‘সুপ্রভাত, মিঃ গুডরিচ!’ ওর পরিবর্তনে দারুণ অবাক হয়ে যাই। তাই একদিন বললাম ‘কে তোমাকে বদলালে?’ সে তখন আপনার সব কথা জানাল। ওর ওই পরিবর্তন দেখেই আপনার কাছে এসেছি।
আমি মিঃ গুডরিচকে বললাম যে তিনি যদি আমার ক্লাসে যোগ দিয়ে যা করতে বলা হবে তাই করলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে আনন্দ পাবেন। তা যদি পারেন তিনি জবাব দেন, তাহলে পৃথিবীতে আমিই হব সবচেয়ে সুখী মানুষ। তিনি আমার ক্লাসে যোগ দিলেন আর অদ্ভুত রকম উন্নতি করলেন। তিন মাস পরে আমি তাকে এক হলঘরে তিনি হাজার মানুষের সামনে মিনিট দুই বক্তৃতা করতে আহ্বান করি। তিনি কথা বলেন প্রায় এগারো মিনিট।
আমার ক্লাসে যারা শিখতে এসেছেন তাঁদের অনেকেরই এ রকম অলৌকিক ব্যাপার ঘটেছে। তাঁদের অনেকেরই এই শিক্ষার ফলে পদোন্নতি ঘটেছে। ব্যবসায় তাদের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, তাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। এ রকম বহু ক্ষেত্রেই হয় যে ঠিক একটা বক্তৃতাতেই এই অলৌকিক কাণ্ড ঘটেছে। এরপর আপনাদের মারিও লাজোর কাহিনী শোনাচ্ছি।