আজ ডেল কার্নেগীর পাঠক্রমের ছাত্র সংখ্যা অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা পাঠক্রমের ছাত্র সংখ্যার চেয়ে বেশি।
ডেল কার্নেগির দাবি যে কোন মানুষই ক্ষেপে গেলে কথা বলতে পারে। তার মত হল আপনি যদি শহরের সবচেয়ে অজ্ঞ লোককেও মুখে ঘুসি মারেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে উন্মত্তের মতই চিৎকার করে মনোভাব প্রকাশ করবে। তিনি আরো বলেন, যে-কোনো মানুষই আত্মবিশ্বাস থাকলে জনগণের সামনে সংলাপে সক্ষম। শুধু তার মনের অভ্যন্তরে আকাঙক্ষা যদি টগবগ থাকে।
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার পথ তার মতে হল, যে কাজে আপনার ভীতি আছে সেই কাজই করা। এই জন্যই তিনি তাঁর পাঠক্রমের ক্লাসে প্রত্যেককে অল্পবিস্তর বক্তৃতা দিতে বলে থাকেন। শ্রোতারাও সহানুভূতিশীল-কারণ তাঁরা সবাই একই নৌকার যাত্রী। একমাত্র ধারাবাহিক অনুশীলনই সাহস, আত্মবিশ্বাস আর আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারে।
ডেল কার্নেগী আপনাদের বলবেন যে তিনি আজ পর্যন্ত এই বক্তৃতা দান শিক্ষা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কিন্তু তিনি অন্য একটা দাবীও করবেন, আর তাহল তার প্রধানতম কাজ মানুষের ভয় দূর করে সাহস জাগিয়ে তোলা।
কার্নেগীর সব ছাত্রই হলেন ব্যবসা জগতের মানুষ। এই জন্যই তারা চাইতেন দ্রুত কোন ফলাফল। যাতে তাদের শিক্ষাকে তারা কাজে লাগতে পারেন। কার্নেগি সে কাজে যে সম্পূর্ণ সফল আজ তাঁর পাঠক্রমের অভাবিত জনপ্রিয়তাই সেকথা প্রমাণ করে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম জেম্স বলেছিলেন, সাধারণ মানুষের সুপ্ত মানসিক ক্ষমতার মাত্র শতকরা দশভাগই জাগিয়ে তোলা সম্ভব। ডেল কার্নেগি বয়স্কদের সুপ্ত ক্ষমতা জাগিয়ে তুলে অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
লাওয়েল টমাস
.
০১. মূল দক্ষতা অর্জনের পথ
যে বছর টাইটানিক জাহাজটি উত্তর আতলান্তিকের শীতল সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয় সেই ১৯১২ সালে আমি জনগণের সামনে কথা বলার ক্লাসে শিক্ষাদান শুরু করি। তারপর থেকে হাজার হাজার মানুষ এই ক্লাসে শিক্ষালাভ করেছেন।
প্রথম ধাপ শুরু করার আগে আগ্রহীদের প্রথমেই সুযোগ দেওয়া হয়–এই শিক্ষাপদ্ধতি থেকে তারা কি লাভ করার আশা করেন সেটা জানাতে। স্বাভাবিক ভাবেই এর উত্তর পাওয়া গেল বিভিন্ন রকম। তবে আশ্চর্যের কথা মূল চাহিদা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু এক! আমাকে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে বলা হলেই আমি অত্যন্ত আত্ম-সচেতন আর ভীত হয়ে পড়ি যে ভালো করে ভাবতে পারি না, কি বলবো তা ভুলে যাই। আমি তাই আত্মবিশ্বাস, স্থৈর্য আর চিন্তা-শক্তি চাই। আমি ব্যবসাজগত বা সামাজিক জগতের সামনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার আর বিশ্বাযযাগ্যভাবে কথা বলতে চাই।’
কথাটা পরিচিত লাগছে নাকি? এর অভাববোধ আপনাকেও বিব্রত করেনি কি? বাইরের জগতের সামনে আপনিও কি চান না বিশ্বাসযোগ্য আর প্রত্যয় উৎপাদনকারী বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা অর্জন করতে? আমার ধারণা, অবশ্যই তা চান। এ বইটা যে পড়তে আগ্রহ বোধ করছেন তাতেই বোঝা যায় আপনি ভালোভাবে কথা বলার শক্তি অর্জনে আগ্রহী।
আমি জানি এর উত্তরে আপনি কি বলবেন : ‘কিন্তু মিঃ কার্নেগী, আপনি কি সত্যিই ভাবেন একদল লোকের সামনে আমি বেশ ঝরঝর করে কথা বলে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করব?’
সারা জীবন ধরেই আমি মানুষকে তাদের ভয় দূর করে সাহস আর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করেছি। আমার ক্লাসে যেসব অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে সে কথা লিখলে কয়েকখানা বইই হয়ে যাবে। তাই এটা কোন ভাবার ব্যাপার নয়। আমি জানি একাজ আপনি পারবেন শুধু এই বইয়ে যে নিয়মের কথা বলা হয়েছে সেগুলো যদি ঠিকমত অভ্যাস করেন।
আপনি যেমন ভাবে বসে থাকতে পারেন তেমন ভাবেই শ্রোতাদের সামনে সোজা দাঁড়িয়ে কেন চিন্তা করতে পারবেন না? শ্রোতাদের সামনে কথা বলতে গেলে ভয় আপনাকে ঘিরে ধরার কোন কারণ থাকতেই পারে না। মনে রাখবেন, এ অবস্থাকে অনায়াসেই বদল করা সম্ভব, শুধু চাই অভ্যাস আর শিক্ষা পদ্ধতি, এর সাহায্যেই এই ভয় দূর করে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা সম্ভব।
এই বইটি আপনাকে সেই উদ্দেশ্য সফল করতেই সাহায্য করবে। এটা সাধারণ পাঠ্য বই নয়। এতে বক্তৃতা দেওয়ার খুঁটিনাটি বিষয় নেই। এতে নেই কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল এতে রয়েছে সারা জীবন ধরে বয়স্কদের বক্তৃতা দেওয়া শিক্ষার অভিজ্ঞতার নির্যাস। যেমন আপনি যেখানে প্রতিষ্ঠিত, সেখান থেকেই আপনি যা হতে চান সেখানেই আপনাকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি এ বই। আপনাকে করতে হবে শুধু সহযোগিতা-এ বইয়ের প্রতিটি নির্দেশ মেনে আপনার কথা বলার সুযোগ এলেই তা কাজে লাগাতে হবে।
এ বই কাজে লাগাতে আপনাকে পরবর্তী চারটি নির্দেশ প্রচুর সাহায্য করবে। ১। অপরের অভিজ্ঞতা স্মরণ করুন।
জন্মগত ক্ষমতালব্ধ বক্তার মতো প্রাণী আর নেই। সেকালে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারকে যখন উন্নত শিল্প বলে ভাবা হত তখন এমন বক্তা হওয়া নেহাতই কঠিন ছিল। আজকের দিনে বক্তৃতাকে কথপোকথনের বাড়তি সংযোজন বলেই ভাবা হয়। অতীতের সেই মনোহারিণী ভঙ্গি আর কণ্ঠস্বর আজ হারিয়ে গেছে। আজকের যুগে আমরা নৈশভোজে, সভায়, গির্জায়, টি ভি বা রেডিওতে শুনতে চাই শুধু সোজাসুজি বক্তৃতা। এখন আমরা চাই বক্তারা আমাদের একাত্ম হবেন, আমাদের দিকে কথা ছুঁড়ে দেবেন না।