আমার প্রায়ই স্যার জর্জের সেই বক্তৃতার কথা মনে পড়ে। তিনি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন, ভাল বক্তার পক্ষে যা একান্তই জরুরি।
আমাদের ক্লাসে কোন সদস্য যখন বলে কোন বিষয় সম্পর্কে আমার উত্তেজনা হয় না। অতি সাধারণ জীবনই আমি কাটিয়েছি, সেখানে উত্তেজনার কোন খোরাক ছিল না। শিক্ষক যখন তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, অবসর সময়ে আপনি কি করেন। ছাত্রটি জবাবে জানায় সে দেশলাইয়ের বাক্স সগ্রহ করে। সে
আরও জানালো পৃথিবীর নানা দেশের দেশলাইয়ের বাক্স তার সংগ্রহে আছে। এ বিষয়ে সে নানা রকম বইও কিনেছে। কথা বলতে বলতে সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। শিক্ষক তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার এই শখের বিষয়েই আমাদের কিছু বলুন না কেন? দারুণ আগ্রহ জাগছে। ছাত্রটি জানালো কারও আগ্রহ জাগবে কিনা সে জানে না। ছাত্রটি শেষ পর্যন্ত তার শখের বিষয়েই চমৎকার বলে যাওয়ার পর শ্রোতারাও তা মন দিয়ে শুনলো। এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় আন্তরিকতা সত্যিই প্রয়োজনীয় বিষয়। এবার তিন নম্বর নিময়টি এই রকম।
বক্তব্য বিষয়ে শ্রোতাদের একাত্ম হন
জনসংযোগের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় জড়িত থাকে : বক্তা, বক্তব্য আর শ্রোতা। প্রথম যে দুটি নিয়মের কথা এই পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে বক্তার সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত বক্তব্য রাখার অবস্থা আসেনি। বক্তা যখন তাঁর বক্তব্য শ্রোতাদের সামনে রাখতে আরম্ভ করেন তখনই কথা বলার অবস্থা প্রাণময় হয়ে ওঠে। বক্তার বক্তব্য হয়তো চমৎকার ভাবেই তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে, বিষয়টাও এমন হতে পারে যাতে বক্তা উত্তেজনা অনুভব করতে পারেন। কিন্তু পুরোপুরি সাফল্য লাভ করার জন্য বক্তার বক্তব্য রাখার মাঝখানে আরও একটি বিষয় এসে পড়ে। বক্তাকে শ্রোতাদের অনুভব করতে দিতে হবে তিনি যা বলতে চলেছেন সেটা শ্রোতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজেই যে শুধু তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন তা নয়, তাঁর ওই উত্তেজনা শ্রোতাদের মধ্যেও জাগিয়ে তুলতে হবে। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সমস্ত বক্তাদের মধ্যেই এই আকর্ষণীয় রূপটি কাজ করে গেছে। একে প্রকাশ করার গুণ বা সেলসম্যানশিপ বা প্রচারের গুণ যাই বলুন না কেন। কার্যকর যে কোন বক্তাই ভেবে নেন আর কামনা করেন তাঁর শ্রোতারা তাঁর মতই অনুভব করেন, তাঁর মতে মত দেন, তাঁর মতই তিনি যা চান তাই তারা করুক আর তার অভিজ্ঞতা তাদের অভিজ্ঞ করে তুলুক। এই বক্তা হয়ে উঠবেন শ্রোতাদের যোগ্য, আত্মকেন্দ্রিক নয়। তিনি জানেন তাঁর বক্তব্যের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে শ্রোতাদের মন আর হৃদয়ের মধ্যে, তাঁর নিজের বক্তব্যের মধ্যেই শুধু নয়।
এমন একটা সময় ছিল যখন আমি জনসংযোগের ক্ষেত্রে কতকগুলো নিয়মের উপর জোর দিতাম, কিন্তু সময় কেটে গেলে আমি বক্তব্য রাখার উপরেই জোর দিতে চেয়েছি।
প্রয়াত মিঃ ব্রায়ান বলেছেন, বাকপটুতা তাকেই বলা যায় বক্তা যা বলেন তা যখন জেনে বলেন … জ্ঞানই এখানে শেষ কথা নয়, শেষ কথা হল বক্তা শ্রোতাদের কতটা একাত্ম করতে পেরেছেন তারই উপর। কোন বক্তাকে তার শ্রোতাদের ঠকানো অসম্ভব–বিশেষ করে তার মনোভাব নিয়ে … প্রায় দু হাজার বছর আগে একজন লাতিন কবি চমৎকারভাবে কথাটা বলে গেছেন : ‘শ্রোতাদের চোখে অশ্রু ঝরাতে চাইলে আপনার নিজের মধ্যেও সেই শোকের ছায়া আনতে হবে।’
আশ্চর্যের কথা জানেন কি? এমনকি ঘোড়াও উত্তেজিত কথায় বিচলিত হয়ে পড়ে। বিখ্যাত পশু শিক্ষক রেইনী বলেছেন ক্রুদ্ধ কথায় ঘোড়ার নাড়ীর গতি প্রতি মিনিটে দশবার বেড়ে যায়। শ্রোতারাও এই ঘোড়ার মতই স্পর্শকাতর।
এ ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা চাই। যতবারই আমরা বক্তব্য রাখি ততবারই আমরা শ্রোতাদের অভিব্যক্তি গড়ে তুলি। তারা আমাদেরই হাতে ক্রীড়নক।
বক্তার বক্তব্যের মধ্যে উত্তাপ, আবেগ, আন্তরিকতার স্পর্শ থাকলে তা বাষ্পের মতই ছড়িয়ে যায়। আমাদের পাঁচশ রকম ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু তাতে আমরা ব্যর্থ হব না। বিখ্যাত রুবেনষ্টাইন বক্তৃতার মাঝখানে অসংখ্যা ভুল বলতেন তবুও তার কথা শ্রোতারা মন দিয়েই শুনতে চাইতেন।
০৪. কথা বলার অধিকার অর্জন
বহু বছর আগে একজন দর্শনের অধ্যাপক আর বহু বছর আগের একজন নাবিক, বর্তমানের সাধারণ মানুষ নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাসে যোগ দেন। অধ্যাপক ভদ্রলোক কলেজে নিযুক্ত ছিলেন আর নাবিকটি ছোট একটি ট্রাক ব্যবসায়ী। অথচ আশ্চর্যের কথা ওই ব্যবসায়ীর কথাই শ্রোতারা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনতে চাইছিল, অধ্যাপকের বক্তব্য তাদের আকর্ষণ করেনি। এরকম হওয়ার কারণ কী? কলেজীয় ভদ্রলোক চমৎকার ইংরাজীতে বলছিলেন। তিনি শহুরে ভদ্রলোক, কৃষ্টিবান নিখুঁত চলাফেরা এবং তাঁর বক্তব্য আগাগোড়াই যুক্তিগ্রাহ্য আর পরিষ্কার। তবে তাঁর মধ্যে একটা জিনিসের অভাব ছিল–সঠিক বক্তব্য। তাঁর কথা আগাগোড়াই কেমন যেন অগোছালো আর অস্পষ্ট। তিনি তাঁর সমস্ত বক্তব্যের মাঝখানে একেবারের জন্যও কোন উদাহরণ রাখেন নি। ব্যক্তিগত কোন অভিজ্ঞতার উদাহরণও রাখেন নি। তাঁর বক্তব্যের আগাগোড়া সরু সুতোয় গাঁধা কতগুলো এলোমেলো ধারণাই বোঝাতে চাইছিল।