শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর সাত বছর গত হয়ে হাওয়ার পর তাঁর নাটকগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আপনি যদি নিউইয়র্কে তাঁর প্রথম সংস্করণটি কিনতে চান তা হলে আপানকে সিকি মিলিয়ন ডলার মূল্য দিতে হবে। অবশ্য শেক্সপিয়ার নিজেও সম্ভবত হ্যামলেট, ম্যাকবেথ ও মিডসামার নাইটস ড্রিম-এর মতো নাটকের জন্য ছয়শ ডলার পান নি। নিজ গ্রামের ছোট এক গির্জার সামনে ধর্মপ্রচার বেদীর পাশে তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। এই সম্মানিত স্থানে তাকে কবর দেয়ার অর্থ তার প্রতিভার প্রতি সকলের সম্মান বোধও নয় অথবা তার প্রতি ভালোবাসার বহিপ্রকাশও নয়। যার কপালে লেখা আছে ইংরেজি সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হওয়ায় তাঁকে গির্জায় কবর দেওয়া হয়েছিল এজন্য যে, তিনি নিজের শরহটাকে টাকা ধার দিয়েছেন। যদি সাইলক চরিত্রের স্রষ্টা তার নিজের শহরটাকে ধার দিতেন তাহলে কোনো পরিচয়হীন কবরে তার হাড়গুলোর কথা হয়তো লোকে আজ ভুলেই যেত।
উড্রো উইলসন : বিশ্বশান্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন
উড্রো উইলসন সম্পর্কে বলা হয়–তিনি ছিলেন একটি বিশাল প্রতিভা, আবার বলা হয়–তিনি ছিলেন একটি বিরাট ব্যর্থতা। তিনি বিশ্ব শান্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নের বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯১৯ সালে উড্রো উইলসন যখন ইউরোপে যাত্রা করেন তখন তাকে যুগশ্রেষ্ঠ ত্রাণকর্তা অভিহিত করে রক্তাক্ত ইউরোপে দেবতাজ্ঞানে স্বাগত জানানো হয়। তাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে সম্মান দিয়ে অনশনকারী কৃষকগণ তার ছবির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা জানাল। সমগ্র বিশ্ব তার পদতলে লুটিয়ে পড়েছিল। অথচ এর তিন মাস পর তিনি যখন অসুস্থাবস্থায় দেশে ফিরলেন কোটি কোটি লোক এমনকি বন্ধুরাও তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। ইতিহাস তাকে আখ্যা দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে উইলসন ছিলেন অত্যন্ত বেশি মানবিকতাবোধসম্পন্ন। তিনি মানুষের সাথে একান্ত নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিলেন।
হোয়াইট হাউসে যারা বাস করেছেন তাদের মধ্যে উইলসনই ছিলেন সম্ভবত শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতব্যক্তি যদিও এগারো বছর বয়স পর্যন্ত লেখাপড়া শেখেন নি। জীবনের অধিকাংশ সময় অধ্যাপনা এবং শিক্ষাঙ্গনের ছায়াময় পরিবেশে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন গরিব। অধ্যাপক হিসেবে তার আয় এত কম ছিল যে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য উপরি আয়ের পন্থা হিসেবে তার স্ত্রী ছবি আঁকতেন। তিনি খাওয়াদাওয়া ও বেশভুষার ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন ছিলেন। তার সামনে যা এনে দেওয়া হত তিনি তাই খেতেন। তার একমাত্র বিলাস ছিল বই কেনা। তিনি জীবনে মাত্র একটি চুরুট টেনেছিলেন এবং তা শেষ করার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
উইলসন ছিলেন যথেষ্ট আবেগপ্রবণ অথচ লোকে তাকে রুজভেল্টের চেয়েও উগ্রস্বভাবের লোক বলে ধারণা করত। তার প্রথমা স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ ছিল অত্যন্ত গভীর। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার অন্যতম প্রধান কাজ ছিল স্ত্রীর জন্য পশমের পোশাক কিনে দেয়া। তিনি আইনবিদ হওয়ার লক্ষে জীবনযাত্রা শুরু করেন কিন্তু আইনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সারা জীবনেও নিজে কোনো মামলা পরিচালনা করেন নি। শুধু এক মক্কেলের সম্পত্তি তদারক করেছিলেন, মক্কেলটি হল তার মা।
উইলসনের চরিত্রের প্রধান ত্রুটি ছিল তার কলাকৌশলের অভাব। ছোটবেলা থেকেই তিনি উচ্চাকাঙ ক্ষা পোষণ করতেন যে, একজন কূটনীতিক হবেন। এভাবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা অভ্যেস করতেন। কিন্তু তিনি জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আয়ত্ত করতে শেখেন নি, সেটা হল-লোকজন পরিচালনা। সেজন্য তার জীবনটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেষ বছরটিতে উইলসন স্বাস্থ্যগতভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তার অবসর গ্রহণের পর পৃথিবীর সব জায়গা থেকে লোকজন এস. স্ট্রিটে তার বাড়িতে তীর্থভ্রমণে এসেছিল।
এনরিকো কারুজো : মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দুর্লভ ও মূল্যবান কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন এনরিকো কারুজো। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ, বাবা তাকে স্কুল ছাড়িয়ে এক কারখানায় কাজে ঢুকিয়ে ছিলেন অর্থোপার্জনের জন্য। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তাঁর। তাই কারখানার কাজ শেষ করে প্রতি দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে সঙ্গীতচর্চা করতেন।
বাড়ির কাছে কোথাও গান গাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি আনন্দে আটখানা হয়ে যেতেন। কোনো মহিলার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে কলকণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য যুবকেরা তাকে ভাড়া করে নিত। নিজের একাগ্র সাধনার ও পরিশ্রমের ফলে অবশেষে যখন তিনি সত্যি সত্যিই অপেরায় গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন মহড়ার সময় এত বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে অক্ষম হলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ভাঙা কাঁচের টুকরোর মতো খানখান করে ভেঙে পড়তে থাকল, বেশ কয়েকবার বিফল হয়ে শেষে কেঁদেই ফেললেন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ থেকে পালিয়ে গেলেন।
যখন তিনি প্রথম এক গীতিনাট্য অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন তিনি ছিলেন মাতাল। তখন তিনি এতই মাতাল ছিলেন যে, শ্রোতারা শিস দিয়ে চিৎকার করে এক মহা হই হুল্লোড় বাধিয়ে দিল। তাদের হট্টগোলের আড়ালে এনরিকোর কণ্ঠস্বর একেবারে তলিয়ে গেল। কোনো এক সন্ধ্যায় গীতিনাট্যের প্রধান অংশগ্রহণকারী নায়ক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এনরিকোও তখন সেখানে ছিলেন না। তাকে খোজার জন্য রাস্তায়-রাস্তায় লোক পাঠানো হল। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল মাতাল অবস্থায়। খবর পেয়ে তিনি যথাসাধ্য দ্রুতগতিতে নাট্যমঞ্চের দিকে ছুটে চললেন। যখন তিনি রূদ্ধশ্বাসে এবং উত্তেজনায় নাট্যমঞ্চে পৌঁছলেন, তখন ড্রেসিং রুমের গরম আর মদের নেশায় তাঁর সহ্যক্ষমতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। সমস্ত রঙ্গমঞ্চটা তার চোখের সামনে নাগরদোলার মতো ভো ভো করে ঘুরতে লাগল। কারুজো যখন মঞ্চে ঢুকলেন, তাঁর অবস্থা দেখে উত্তেজিত দর্শকরা আরো হট্টগোল বাধিয়ে তুলল, রঙ্গালয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। অনুষ্ঠানের পর তীব্রভাবে তিরষ্কার করা হল। এতে ভগ্নহৃদয়ে ও হতাশমনে সেদিন কারুজো আত্মহত্যা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন।