১৮৯৩ সালের এক রোদঝলসানো গরম দিনে হেটি গ্রিন বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এক গুদামঘরের চিলেকোঠায় উঠলেন। টিনের চালের নিচে অত্যন্ত গরমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রঙিন কাপড়ের টুকরো থেকে সাদা টুকরোগুলো আলাদা করতেন। এ কাজের জন্য খরিদ্দার প্রতি পাউন্ডের জন্য তাকে এক সেন্ট মূল্য বেশি দিত।
তার জমানো টাকার হিসেব দেখাশোনা করার জন্য অধিক সময় তাকে ওয়েল স্ট্রিটে কাটাতে হত। তিনি জানতেন, যদি নিউইয়র্ক সিটিতে একটা রুম ভাড়া নেন অথবা যদি একখণ্ড আসবাবপত্রেরও মালিক হন তা হলে ট্যাক্স কালেক্টর তার কাছ থেকে ছোঁ মেরে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ট্যাক্স কালেক্টরের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য একটা সস্তা বাসা থেকে আরেকটা সস্তা বাসায় সরে যেতেন। তিনি ছদ্মনামে বাসা ভাড়া করতেন, ছেঁড়া কাপড় পরে থাকতেন। সাথে এত সামান্য জিনিসপত্র রাখতেন। যে তার সন্দেহে প্রধান বাড়িওয়ালারা তার রাত্রিযাপনের ভাড়াটা অগ্রিম আদায় করে ছাড়ত। তার এক বান্ধবী তাকে সৌন্দর্যচর্চার প্রসাধনীর জন্য তিনশ ডলার ব্যয় করতে রাজি করাল। তাকে গ্রারান্টি দেয়া হল যে এই প্রসাধনী ব্যবহার করলে তার বয়স কম দেখাবে।
হেটি গ্রিন নিউইয়র্কের কেমিক্যাল ন্যাশনাল ব্যাংকে কয়েক মিলিয়ন ডলার জমা রেখেছিলেন। চেক জালিয়াতের ভয়ে নিত্যন্ত বাধ্য না হলে তিনি চেকে সই করতেন না। তার ট্রাঙ্ক ও স্যুটকেসগুলো ব্যাংকে জমা রাখতেন। তিনি একটি এক ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ব্যাংকে আসতেন, এর চাকাগুলো খুলে ব্যাংকের দোতালায় উঠিয়ে রাখতেন।
হেটি গ্রিন অনেক দিক দিয়ে ছিলেন দয়ালু হৃদয়ের। ন্যাশনাল ব্যাংকে এক দারোয়ান ছিলেন, একবার ব্যাংক থেকে তাকে বরখাস্ত করায় হেটি গ্রিন তার জন্যে এত দুঃখ বোধ করেছিলেন যে, তিনি নিজে একসপ্তাহ সময় ব্যয় ও খোঁজাখুঁজি করে তাকে আরেকটা চাকরি যোগাড় করে দিলেন।
হেটি গ্রীন একাশি বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর শেষ পীড়ায় যে সেবিকারা সেবা করতে এসেছিল তাদের সাদা ইউনিফর্ম পরতে দেয়া হয় নি। তারা রাস্তায় বেড়ানোর পোশাক পরত যাতে হেটি ভাবেন যে সাধারণ ভৃত্য, কারণ যদি হেটি সন্দেহ করতেন যে তারা ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকা তাহলে তিনি শান্তিতে মরতে পারতেন না।
হেলেন কিলার : যাকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল
জন্মগ্রহণের সময় হেলেন কিলার ছিলেন একটি স্বাভাবিক শিশু। তাঁর জীবনের প্রথম দেড়টি বছর অন্যান্য শিশুদের মতোই দেখতে ও শুনতে পেতেন এমনকি কথাও বলতে পারতেন। হঠাৎ করে এক মহাদুর্যোগ দেখা দিল তার জীবনে। তিনি ভয়ানক অসুখে পড়লেন। মাত্র উনিশ মাস বয়সেই হয়ে গেলেন বধির, বোবা এবং অন্ধ। তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ নয়টি বছর তিনি বাকশক্তিহীন ছিলেন। অথচ এই মহিলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে বক্তৃতা করেছেন এবং ইউরোপের সব দেশ ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ছোটবেলায় অবোধ বন্যপ্রাণীদের মতো তিনি বড় হতে থাকলেন বোবা, কালা ও অন্ধত্বের অভিশাপ নিয়ে। যা কিছু তার খারাপ লাগত তাই ভেঙে তছনছ করে ফেলতেন। তিনি দু-হাত দিয়ে মুখে খাবার খুঁজতেন; এ অভ্যাস শুধরাবার চেষ্টা করলে তিনি রাগে হাত পা ছুঁড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিতেন আর চিৎকার করে কাঁদার চেষ্টা করতেন।
অবশেষে হেলেন কিলারের অসুখী বাবা-মা বোস্টনের একটি অন্ধ প্রতিষ্ঠানে হেলেন কিলারকে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে এ্যান মেনসফিল্ড সুলিভান নামক এক মহিলা হেলেন কিলারকে সারিয়ে তোলার ও শিক্ষাদানের অসম্ভব কাজটির দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। মিস্ সুলিভানের বয়স ছিল তখন মাত্র কুড়ি। নিজের জীবনটা ছিল অত্যন্ত দুঃখময় ও দারিদ্র্যপূর্ণ।
এ্যান সুলিভান ও তার এক ছোট ভাইকে ম্যাসাচুসেট্স-এ এক দরিদ্র ভবনে পাঠানো হয়েছিল। দরিদ্র ভবনে এত বেশি গরিব ছেলেমেয়ে থাকত যে, ওদের দুজনকে মৃতের ঘরে ঘুমুতে হত, এ ঘরে যেসব মৃতব্যক্তিকে কবর দেয়া হবে তাদেরকে রাখা হত। ছ’মাস পরে সুলিভানের ছোটভাইটি মারা যায় দরিদ্র ভবনে। আর সুলিভান ও চৌদ্দ বছর বয়সে প্রায় অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। যার জন্য তাকে পরে অন্ধ প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। এ্যান সুলিভান সেখানে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান এবং পরবর্তীতে হেলেন কিলারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
এ্যান সুলভান কীভাবে হেলেন কিলারের মধ্যে অলৌকিক পরিবর্তন ঘটালেন এবং তার মনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করলেন তা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। হেলেন কিলারের লেখা আমার জীবন কাহিনী’তে উদ্ধৃত আছে, যেদিন হেলেন কিলার প্রথম কথা বলতে শিখলো সেদিনের তার আনন্দটি অপরিমেয়।
হেলেন কিলারের বয়স যখন বিশ বছর, লেখাপড়ায় তিনি যথেষ্ট অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি রেডক্লিক কলেজে ভর্তি হন। তিনি কেবল শিখতে ও পড়তে পেরেছিলেন তা নয়, তার বাকশক্তিও ফিরে পেয়েছিলেন। তিনি যে বাক্যটি প্রথম শিখলেন তা হল—’আমি এখন আর বোবা নই।‘ কথাগুলো বলতে পারার আনন্দে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন।
মার্ক টোয়েন বলেছেন, উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি চরিত্র হল সম্রাট নেপোলিয়ান এবং হেলেন কিলার। আজ এ বিংশ শতাব্দীতেও হেলেন কিলার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে বিরাজ করছেন। হেলেন কিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ; কিন্তু দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন বহু লোকের চেয়েও তিনি অধিক সংখ্যক বই পড়তে সক্ষম হয়েছেন। একজন সাধারণ মানুষের চেয়েও একশ গুণ বেশি বই পড়েছেন এবং নিজেও লিখেছেন এগারোটি। নিজের জীবনকাহিনী অবলম্বনে তিনি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। আরো আশ্চর্যের বিষয় তিনি বধির হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সুস্থ লোকের চেয়েও তিনি সঙ্গীত উপভোগ করতেন বেশি। তিনি এখন সামান্য বিদেশী উচ্চারণে কথা বলতে পারেন। হেলেন কিলার যখন হাঁটেন তখন প্রায়ই আপন মনে কথা বলেন কিন্তু আপনার আমার মতো ঠোঁট নাড়েন না, বরং আঙুল নেড়ে সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজের সাথে কথা বলেন। অনেকে মনে করেন যে, যেহেতু তিনি অন্ধ, তার হয়তো রহস্যজনক ষষ্ঠেন্দ্রিয় আছে। তার আরেকটি অন্ধুত দক্ষতা ছিল, তা হল তার বন্ধুরা যখন তার সাথে কথা বলত, তারা কী বলত তা তিনি তাদের ঠোঁটের উপর আলতোভাবে আঙুল রেখে বুঝতে পারতেন।